ফিরে আসছে ‘৪২০’–এর মন্টু ও কিসলুরা
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একসময়ের (২০০৭–০৮) জনপ্রিয় রাজনৈতিক টিভি থ্রিলার ধারাবাহিক ‘৪২০’–এর কথা কি মনে আছে? ‘কিসলু’ আর ‘মন্টু’ দুই অল্প/অর্ধশিক্ষিত যুবকের গ্রাম থেকে শহরে এসে রাতারাতি জননেতা বনে যাওয়া আর বিভিন্ন কূটচালের মাধ্যমে প্রথম দিকে আশ্রয়প্রাপ্ত বাড়িটা দখল করে নেওয়া ধারাবাহিকটির অন্যতম আকর্ষণ। শেষমেশ পরিষ্কার ভাবমূর্তি ও আদর্শ রাজনীতিবিদদের খতম/হত্যা করে নিজেরা ‘জনশক্তি পার্টির’ চালিকা শক্তি তথা এলাকার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে—আমজনতা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। নাটকের কাহিনি হলেও আমাদের সমাজে এমন নেতার আধিক্য বোধ করি বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের কয়েকজন ছাত্রসহ আমি (২০০৬–০৭ সাল) একটি ব্যবহারিক কোর্সের অংশ হিসেবে তুরাগ ও বালু নদের মানচিত্রায়ণ অনুশীলন করতে যাই। যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল মনে হলে এখনো গা ছমছম করে, মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের ভিডিও ক্যামেরা, জিপিএস ডিভাইসগুলোর ওপর আঘাত আর ব্যাপক হুমকি–ধমকি। অবস্থা এমন হলো, জীবন নিয়ে ফেরা দায়। ১০-২০ মিনিটের মধ্যে ২০-৩০ জন মিলে আমাদের অনুশীলন বন্ধ করতে বাধ্য করল, অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কিছু হলো না। পরে জানতে পারি রাতের আঁধারে বালু ফেলে নদী ও ভূমি দখলের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে যাবে আশঙ্কায় স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভুরা আমাদের অনুশীলন বন্ধ করেছিল।
স্মরণাতীতকাল থেকে দেশের ভূমির গঠন, কৃষিকাজ, স্বাদু পানির মাছ, জীবিকার বিকাশ আর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধিকরণে নদ-নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যেহেতু বাংলাদেশ নদীবাহিত পলল দ্বারা তৈরি, ভূমি গঠন ও বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি দ্রুত পরিবহনে ছোট–বড় নদীগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। পরিতাপের বিষয় আমরা কখনোই এদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারিনি, পারলে আজ এমন দশা হতো না। আমাদের নদ-নদীগুলোর বর্তমান বেহাল দশার কারণ অনেক। সর্বাগ্রে যেটা তা হলো সুনির্দিষ্ট সীমানা ও যথাযথ সংজ্ঞার অভাব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বলতে হচ্ছে নদ-নদী ও জলাশয়গুলোর নির্দিষ্ট ডেটাবেইস তৈরির কথা। সরকারের এত দপ্তর, ৫০ বছরেও কি পারল না একটা নির্ভুল তথ্যভান্ডার তৈরি করতে?
২০১৭ সালে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ১৩০০ নদীর মধ্যে ৬০০ জীবিত আর বাকিরা মৃত। দ্বিতীয়ত, নদ-নদী সম্পর্কিত আলাদা মন্ত্রণালয়ের অভাব, যদিও সম্প্রতি নদী রক্ষা কমিশন হয়েছে। যত দূর জানা যায়, সরকারের অন্তত ৫-৬টি মন্ত্রণালয় দেশের নদী এবং জলাশয়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত। একদিকে এটা খুশির কারণ, কেননা দশের লাঠি একের বোঝা অর্থাৎ অনেক সংস্থা মিলে নদ-নদীর সুরক্ষা দিচ্ছে। আর দুঃখের কারণ, সবাই মিলে নদী ও জলাশয়খেকোদের নিরাপত্তাও দিচ্ছে বললে অন্যায় হবে কি? হ্যাঁ, এগুলোর সুরক্ষায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ দেখলে মনে হবে ‘শেষ হইয়া ও হইল না শেষ’।
আমাদের নদ-নদীগুলোর বর্তমান বেহাল দশার কারণ অনেক। সর্বাগ্রে যেটা তা হলো সুনির্দিষ্ট সীমানা ও যথাযথ সংজ্ঞার অভাব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বলতে হচ্ছে নদ-নদী ও জলাশয়গুলোর নির্দিষ্ট ডেটাবেইস তৈরির কথা। সরকারের এত দপ্তর, ৫০ বছরেও কি পারল না একটা নির্ভুল তথ্যভান্ডার তৈরি করতে?
বলা বাহুল্য, প্রথম দিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সীমাবদ্ধতা থাকলেও ২০২০ সালের খসড়া আইনে এই সংস্থাকে দেশের নদ-নদী, খাল–বিল এবং জলাশয়ের আইনগত অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সময়ই বলবে তুলনামূলকভাবে নতুন এই সংস্থা দুদকের মতো হবে নাকি দৃশ্যমান কিছু করে দেখাতে পারবে। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর নদ-নদী ও জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণে বালখিল্য। যেমন: ঢাকার নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণে বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ) ৩-৪ বছর ধরে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে (প্রথম আলো, ৯ জানুয়ারি), আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হবে নির্ভুল। কিন্তু গন্ডগোল বাধে বেসরকারি সংস্থা যখন জরিপ করে দেখতে পায় সীমানা নির্ধারণে পিলারের অবস্থান ভুলে ভরা। কতটা বিভ্রান্তিকর, কে সত্য কে মিথ্যা—কেউ জানে না, অথচ ৮৫০ কোটি টাকা শেষ। যদিও বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট পরিচালক বেসরকারি সংস্থার জরিপের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন, তারা অনুমোদনহীন জরিপ করতে পারে না।
অন্যদিকে রাজউক কর্তৃক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (প্রস্তাবিত) মুখ্য জলস্রোত এলাকা ব্যতীত বাকি দুই ধরনের শ্রেণিতে (সাধারণ প্লাবনভূমি ও সাধারণ জলস্রোত) ভূমি ব্যবহার ও স্থাপনা অনুমোদনের প্রস্তাব করা হয়েছে। মানে দাঁড়াচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলোর হয় দক্ষতার অভাব বা ‘অজানা’ কারণে একেক সময় একেকভাবে তারা নদ-নদী ও জলাশয়গুলোকে সংজ্ঞায়িত করে, যা পরোক্ষভাবে দখলদারিকে উৎসাহিত করছে। নদী টাস্কফোর্সের হিসাবে ঢাকায় একসময় ৬৫টি খাল ছিল, যা বর্তমানে ২৬টি। প্রস্তাবিত আইনগুলোর যদি বা কোনো ফাঁকফোকর থাকে অথবা হালনাগাদে সময় লাগলে ‘মন্টু’ আর ‘কিসলু’দের সর্বজনীন সম্পদকে গ্রাস করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না।
বিজ্ঞাপন
সবশেষ কারণটি আরও প্রকট অর্থাৎ নদী ও জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নেই। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ২০২০ সালে ডিসেম্বরে ঢাকা ও মানিকগঞ্জের নদীগুলো সরেজমিনে ঘুরে এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশ। কথা হচ্ছে আইন থাকলে তার প্রয়োগ যদি না থাকে তবে নতুন আইন করে কি লাভ? শুধুই কি ব্যক্তি বা সংস্থার কলেবর ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য? প্রস্তাবিত আইনগুলো কি পারবে দেশের নদ-নদী ও জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে? ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করেও আমরা কি পেরেছি নারীর সুরক্ষা ও ধর্ষণ বন্ধ করতে? আসলে প্রয়োজন নীতিনৈতিকতার শিক্ষা আর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির, দুটোর অভাবই দিন দিন সব অর্জনকে ম্লান করছে বললে কি অত্যুক্তি হবে?
দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে একসময় বিদেশিদের ব্যবস্থাপত্রে চলত নদীগুলো বাঁধবন্দীর পাঁয়তারা আর এখন চলছে স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রভুদের দ্বারা নদ-নদী ও জলাশয়গুলো দখলের মহোৎসব। আর এই উৎসবে যদি থাকে রাজনৈতিক প্রভাব ও সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহায়তা, তাহলে দেশের সম্পদ নিজের করতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াতে যে সময় প্রয়োজন, তার চেয়েও সময় কম লাগে। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বন্ধুকে দেশের বন উজাড়ের কারণ জিজ্ঞাসা করতে উনি যা শোনালেন তাতে চক্ষু চড়কগাছ। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ যেমনি প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে দেশের বন, তেমনি ঢাকাসহ সারা দেশে রাজনীতির মোড়কে ঘরে ঘরে তৈরি হয়েছে ‘৪২০’ নাটকের হাজারো ‘মন্টু’ আর ‘কিসলু’, যাঁদের লোলুপ দৃষ্টি সব সময় অন্যের সম্পদ বা নদ-নদী ও জলাশয়ের ওপর। আর তাঁদের কাছে আইন মানে শুধুই কাগুজে নিয়ম।
যেহেতু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে এগুলোর দেখভালে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ঘোষিত হয়েছে, কাজের স্বাধীনতা আর দক্ষ জনবল থাকলে এই মহামূল্যবান নৈসর্গিক সম্পদগুলো অবশ্যই রক্ষা করা সম্ভব।
নদী রক্ষা কমিশনের কর্তাব্যক্তি নিজেই নদ-নদী ও জলাশয়গুলোর দখলের ক্ষেত্রে স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রভুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অসামান্য অবদানের কথা সম্প্রতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে গণমাধ্যমে এসেছে। দেশের নদ-নদী, খাল–বিল ও জলাশয়গুলো যদি কথা বলতে পারত, তাহলে এগুলোর দখলদারদের জেলে রাখার জায়গার অভাব হতো, কারণ কমিশনটি ৬৪ জেলার ৫৮টিতে দখলদারির প্রমাণ পেয়েছে।
অদ্যাবধি পর্যন্ত বিশ্বের জলবায়ুর মডেলিংয়ে দেখা যায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গঙ্গা-যমুনা-মেঘনা অববাহিকায় আকস্মিক ও অনিয়মিত বন্যার প্রকোপ বাড়বে, যার কিছুটা ২০২০ সালে দেশব্যাপী পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই দেশের মানুষ ও সম্পদকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য নদ-নদী ও জলাশয়গুলোর সুনির্দিষ্ট সজ্ঞায়ন এবং সুচারু সীমানা নির্ধারণ জরুরি, যাতে তীরবর্তী স্থাপনা ও মনুষ্য বসতি রোধ করা যায়।
যেহেতু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে এগুলোর দেখভালে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ঘোষিত হয়েছে, কাজের স্বাধীনতা আর দক্ষ জনবল থাকলে এই মহামূল্যবান নৈসর্গিক সম্পদগুলো অবশ্যই রক্ষা করা সম্ভব। আর ‘মন্টু কিসলু’দের নিয়ন্ত্রণে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার। না হলে নাটকের একপর্যায়ে ‘মন্টু কিসলু’রা যেমন একদা শিষ্য ‘বিসু’র হাতে ক্ষমতা হারায়, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ‘বিসু’রাই থাকবে সর্বক্ষেত্রে চালকের আসনে। পরিণতি নিশ্চিতরূপে ‘৪২০’ নাটকের মতো, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
আশরাফ দেওয়ান স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।