শিশু সুমা: রুগ্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসহায় বলি

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের এই প্রতিবেদনটি প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ১৯ মে। পরদিন প্রথম আলোতে প্রতিবেদনটি কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে ছাপা হয়। গত সোমবার কোভিড জটিলতায় মারা গেছেন মিজানুর রহমান খান। তাঁর লেখাটি পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশিত হলো। প্রতিবেদনের জন্য তিনি ছবি তুলেছিলেন, ভিডিও করেছিলেন।

মেয়েশিশুটির মুখে ছিল অক্সিজেনের মাস্ক। এক নারীর কাঁখে করে নেওয়া হচ্ছিল তাকে। সিলিন্ডারটি বয়ে আনছিলেন আরেকজন। কোনো স্ট্রেচার ছিল না। তারা এভাবে হেঁটে ওঠেন একটি অ্যাম্বুলেন্সে। স্থানটি শিশু হাসপাতাল। গত শনিবারের বিকেল পাঁচটা।

শিশু হাসপাতালে তাঁরা এসেছিলেন শুক্রবার ভোররাত সাড়ে তিনটায়। কিন্তু তাঁরা কেউ শিশুটির মা-বাবা নন। তাঁরা মেয়েটির চাচা ও ফুফু।

শিশুটির নাম সুমা। বয়স ১ মাস ২৮ দিন। কেরানীগঞ্জে গাড়িচালক বাবার ঘরে যমজ বোন সুমাইয়ার সঙ্গে তার জন্ম। কিন্তু জন্মের পরই তার ‘হার্টের সমস্যা’ দেখা দেয়। তার শ্বাস নেওয়ার কষ্ট বাড়লে তাকে শিশু হাসপাতালে আনা হয়। বড় চাচা আতাউলও গাড়িচালক। তিনি নিজেই একটি পিকআপে সুমাকে নিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, তিন-চার রকম টেস্ট করান তাঁরা। সব মিলিয়ে আট হাজার টাকার মতো খরচ হয়। তবে হাসপাতাল স্টাফরা পরামর্শ দেন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কারণ, তাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। শিশু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তাই তারা একটি অ্যাম্বুলেন্সে শিশু হাসপাতাল ছাড়েন। তখনো তাঁদের গন্তব্য জানা ছিল না। এই প্রতিবেদক তাঁদের অজান্তে পিছু নেন।বিজ্ঞাপন

দৃশ্যপট-২

অ্যাম্বুলেন্সটি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গেটে গতি কমালেও ঢোকে না। থামে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে প্যান কেয়ার হাসপাতালে। তখন শনিবারের বিকেল ৫টা ২১। ভেতরে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করেন। বলেন, চাইলে সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে পারেন। শুধু বেডভাড়া দৈনিক সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবে শিশুটির জন্য দরকারি আইসিইউ বেড খালি নেই।

দৃশ্যপট-৩

প্যান কেয়ারের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন সবাই। আতাউল আমার কাছে জানতে চান, এরপর তাঁরা কোথায় যাবেন। আমার পরামর্শে অ্যাম্বুলেন্সটি যাত্রা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এর আগে সরেজমিন পরিদর্শনে আমার জানা ছিল, পুরোনো ভবনটি খাঁ খাঁ করছে। রোগীশূন্য। কিন্তু সুচিকিৎসার সব ব্যবস্থাই বহাল। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন আমাকে বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালের প্রতিষ্ঠাকালীন চেহারায় ফিরেছে হাসপাতালটি।

১৬ মে। সন্ধ্যা ৬টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে ফোন দিই। তিনি সুমাকে ভর্তি করানোর আশ্বাস দেন। তবে হাসপাতালে গেটে পৌঁছালেই বাধা দেন এক স্টাফ। বলেন, মেডিসিনের রোগী এখানে না নেওয়ার নির্দেশনা আছে। রোবেদ আমিনের বরাতে কাজ হয়। ভেতরে শিশু ওয়ার্ডে নিতে রাজি হন। ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি সব বেডই খালি।

দৃশ্যপট-৪

৬টা বেজে ২৫। হাসপাতাল থেকে বেরোতেই শিশুটির চাচা আতোয়ার ফোন দেন। কথা হয় ওই ওয়ার্ডের মেডিকেল অফিসার মির্জা সাকির সঙ্গে। তিনি বলেন, এই ওয়ার্ডের ছয় বেডের আইসিইউ লকডাউন। সপ্তাহ আগে আইসিইউর একজন নার্স করোনায় আক্রান্ত হন। এরপর থেকে এটি বন্ধ। তিনি ভর্তি করতে প্রস্তুত। তবে তিনি হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বললাম, এটা ইফতারের সময়, অক্সিজেন দিতে পারবেন না? তিনি বললেন, ‘সেটা সম্ভব। আমরা অবশ্যই দেব।’ তখন তাঁকে আরও বললাম, অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছিলেন, এখানে শিশুদের জন্য ৪২ শয্যার আইসিইউ বেড আছে। সাকি বললেন, ‘সেটা শুধু অনধিক ২৮ দিন বয়সী শিশুদের জন্য। এই শিশুর বয়স ১ মাস ২৮ দিন। তাই ওখানে সম্ভব নয়।’ বললাম, দেশে একটা জরুরি অবস্থা চলছে। কোনোভাবে ম্যানেজ করা যায় কি না।

দৃশ্যপট-৫

১৭ মে। রাত ১টা ৫৮ মিনিট। আতোয়ার টেলিফোনে আমাকে বললেন, মেয়েটি নড়াচড়া করে না। ইসিজি করতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ৪০ মিনিটি ধরে ঘুরেছেন। পুরোনো ভবন থেকে নতুন ভবন, দোতলা থেকে তিনতলায় ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু শেষে জেনেছেন, ইসিজি হবে না। সব বন্ধ। লোক নেই।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ২টা ২৭ মিনিট। আতাউলের ফোন আসে। বলেন, সুমা মারা গেছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. তাহমিনা ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, এ রকম হার্টের বাচ্চাকে আইসিইউতে রাখা নিয়ম। তাঁরা সেটা জেনেবুঝে রিস্ক বন্ডে সাইন দিয়ে বাচ্চাকে ভর্তি করান। ৪২ শয্যার আইসিইউতে ভর্তি প্রসঙ্গে বলেন, ওটা শুধু অনধিক ২৮ দিনের বাচ্চাদের জন্য উপযোগী। চাইলেও ৫৮ দিনের এই বাচ্চাকে রাখা যেত না।বিজ্ঞাপন

দৃশ্যপট-৬

ভোর ৪টা ৩৬। আতাউলেরা সুমার মৃতদেহ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হন। সুমার ফুফুসহ সবারই আফসোস, তাঁরা যত্নটুকুও পেলেন না!

সুমার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা: হার্ট ফেইলিওর। মৃত্যুর সময়: ২টা ৩৫ মিনিট।

সুমাকে ১৭ মে সকাল ৯টায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানার সৈয়দপুরে দাফন করা হয়েছে।

দৃশ্যপট-৭

অধ্যাপক রোবেদ আমিন মনে করেন, সুমার জন্য আইসিইউ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। নিওন্যাটাল আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনীষা ব্যানার্জি এই প্রতিবেদককে জানান, যে সময়ে সুমা সেখানে ছিল, সে সময়ে নিওন্যাটাল আইসিইউয়ে ১৮টি শিশু সেবা পাচ্ছিল, বাকি আইসিইউ সুবিধাগুলো ছিল খালি। তবে তিনি মনে করেন, সুমার বয়স বেশি ছিল বিধায় তাঁর বিভাগে সুযোগ ছিল না। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র ফ্লোরিডার জ্যাকসনভিলে উলভসন চিলড্রেন হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেছেন, তাঁদের হাসপাতালেও তাঁরা দরকার পড়লে নিওন্যাটাল বিভাগের আইসিইউতে ২৮ দিনের বেশি বয়সী শিশুদের রাখেন। সুতরাং ২৮ দিনের বেশি বয়সী শিশুদের সেখানে রাখা যায় না, এ কথা সঠিক নয়।

১৮ মে

সুমা যে বিভাগের ভর্তি হয়েছে, অধ্যাপক ড. সাঈদা আনোয়ার সেই বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকস) প্রধান। আইসিইউ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বেও তিনি। জানতে চাইলে তিনি টেলিফোনে শিশুটির মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেন। বললেন, ২৮ দিনের বেশি বয়স হওয়ার কারণে নিওন্যাটাল আইসিইউতে তাকে ভর্তি করানো সম্ভব ছিল না। আর ছয় শয্যার আইসিইউর চারটিতে ভেন্টিলেটর আছে, দুটিতে নেই। এর একটিও সুমাকে দেওয়া সম্ভব ছিল কি না? অবহেলা ঘটেছে কি না? উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো তাকে দেখিনি। তবে আইসিইউ পায়নি বলেই মারা গেছে, সেটা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। হয়তো তার অবস্থা খারাপ ছিল।’ তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, খারাপ রোগীদেরও অনেক সময় তাঁরা ভর্তি করান। ঢাকা মেডিকেলে ২৮ দিনের বেশি বয়সের শিশুদের আইসিইউ সুবিধা প্রথম চালু হয় গত বছরের শেষার্ধে। তাঁর কথায়, এই মেয়েটির যদি শিশু কার্ডিওলজিস্টের দেখার দরকার পড়ত, তাহলে সেটা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, হাসপাতালে এই পদই নেই।

অধ্যাপক সৈয়দা আনোয়ার অবশ্য এ কথাও বলেন যে আইসিইউ পরিচালনার লোকবলেরও ঘাটতি আছে। ওই বিভাগে করোনা পজিটিভ পাওয়া এবং কোভিড বিভাগে লোকবল স্থানান্তরের কারণে এটা ঘটেছে।

তবে করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে আইসিইউ লকডাউন রাখার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত দিয়েছেন। বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রিন্সিপাল, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার এবং হেড অব ইকুইপমেন্টস মেইনটেন্যান্স প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অবস্থায় আইসিইউ জীবাণুমুক্তকরণ (ফিউমিগেশন) করা দরকার পড়ে। আর সেটা একবার করলে দুই দিন এবং সন্দেহমুক্ত হতে চাইলে দ্বিতীয়বারে আরও দুই দিন, এই মোট চার দিন বন্ধ রাখলেই চলে।’

আইসিইউও কি মানুষ যে তাকেও ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে?

করোনায় আইসিইউ সংকট বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ সুবিধা অপরিহার্য। কিন্তু নন-কোভিড রোগী ছিল সুমা নামের মেয়েটি। অধ্যাপক সৈয়দা হয়তো ঠিক বলেছেন, আইসিইউ সুবিধা পায়নি বলেই সুমা মরেছে, তা হয়তো ধরে নেওয়া যাবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হওয়ার পর সাত দিন কেটেছে। জাতির এত বড় স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার মধ্যে যখন ‘আইসিইউ লকডাউন’ থাকে, দায়িত্বশীল কেউ যখন মুঠোফোনে বলেন, এখনো তো ‘চৌদ্দ দিন পার হয়নি’, তখন তা ভয়ানক নৈতিক দীনতা নির্দেশ করে। সরকার স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ালেও এই দৈন্য দূর হবে না।

তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। আতাউলের স্ত্রী মাকসুমার কোলে সুমার লাশ। আমি ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের গেটে তাঁদের বিদায় জানাই। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করি। ঢাকা মেডিকেল তো আসলে সুমাকে ভর্তি করাতেই চায়নি। হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে গেলে কি সুমা ঠাঁই পেত আইসিইউতে? আমি প্রায় নিশ্চিত, ডা. রোবেদের বরাত না দিলে ঢাকা মেডিকেলে তারা ঢুকতেই পারত না। গত কয়েক দিনে হাসপাতালগুলোয় ঘুরে শূন্য বেডগুলো দেখে বুঝেছি, নন-কোভিড রোগীদের সেখানে স্বাগত জানানো হলে বেডগুলো খালি পড়ে থাকত না।

তাই সুমার মৃত্যু ঠিক কোনো কিছুর দৈন্য নয়, এটা দণ্ডনীয় অবহেলার একটি উদাহরণ। সুমা নামের শিশুটি আমাদের রুগ্‌ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক অসহায় বলি।

ফুফু নার্গিস আক্তারের কোলে শিশু সুমা। অক্সিজেনের সিলিন্ডার হাতে সামনে হাঁটছেন চাচা আতাউল। ১৬ মে ২০২০ বিকেল পাঁচটায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে শিশু হাসপাতালে
ফুফু নার্গিস আক্তারের কোলে শিশু সুমা। অক্সিজেনের সিলিন্ডার হাতে সামনে হাঁটছেন চাচা আতাউল। ১৬ মে ২০২০ বিকেল পাঁচটায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে শিশু হাসপাতালে

মেয়েশিশুটির মুখে ছিল অক্সিজেনের মাস্ক। এক নারীর কাঁখে করে নেওয়া হচ্ছিল তাকে। সিলিন্ডারটি বয়ে আনছিলেন আরেকজন। কোনো স্ট্রেচার ছিল না। তারা এভাবে হেঁটে ওঠেন একটি অ্যাম্বুলেন্সে। স্থানটি শিশু হাসপাতাল। গত শনিবারের বিকেল পাঁচটা।

শিশু হাসপাতালে তাঁরা এসেছিলেন শুক্রবার ভোররাত সাড়ে তিনটায়। কিন্তু তাঁরা কেউ শিশুটির মা-বাবা নন। তাঁরা মেয়েটির চাচা ও ফুফু।

শিশুটির নাম সুমা। বয়স ১ মাস ২৮ দিন। কেরানীগঞ্জে গাড়িচালক বাবার ঘরে যমজ বোন সুমাইয়ার সঙ্গে তার জন্ম। কিন্তু জন্মের পরই তার ‘হার্টের সমস্যা’ দেখা দেয়। তার শ্বাস নেওয়ার কষ্ট বাড়লে তাকে শিশু হাসপাতালে আনা হয়। বড় চাচা আতাউলও গাড়িচালক। তিনি নিজেই একটি পিকআপে সুমাকে নিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, তিন-চার রকম টেস্ট করান তাঁরা। সব মিলিয়ে আট হাজার টাকার মতো খরচ হয়। তবে হাসপাতাল স্টাফরা পরামর্শ দেন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কারণ, তাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। শিশু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তাই তারা একটি অ্যাম্বুলেন্সে শিশু হাসপাতাল ছাড়েন। তখনো তাঁদের গন্তব্য জানা ছিল না। এই প্রতিবেদক তাঁদের অজান্তে পিছু নেন।বিজ্ঞাপন

দৃশ্যপট-২

অ্যাম্বুলেন্সটি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গেটে গতি কমালেও ঢোকে না। থামে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে প্যান কেয়ার হাসপাতালে। তখন শনিবারের বিকেল ৫টা ২১। ভেতরে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করেন। বলেন, চাইলে সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে পারেন। শুধু বেডভাড়া দৈনিক সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবে শিশুটির জন্য দরকারি আইসিইউ বেড খালি নেই।

দৃশ্যপট-৩

প্যান কেয়ারের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন সবাই। আতাউল আমার কাছে জানতে চান, এরপর তাঁরা কোথায় যাবেন। আমার পরামর্শে অ্যাম্বুলেন্সটি যাত্রা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এর আগে সরেজমিন পরিদর্শনে আমার জানা ছিল, পুরোনো ভবনটি খাঁ খাঁ করছে। রোগীশূন্য। কিন্তু সুচিকিৎসার সব ব্যবস্থাই বহাল। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন আমাকে বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালের প্রতিষ্ঠাকালীন চেহারায় ফিরেছে হাসপাতালটি।

১৬ মে। সন্ধ্যা ৬টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে ফোন দিই। তিনি সুমাকে ভর্তি করানোর আশ্বাস দেন। তবে হাসপাতালে গেটে পৌঁছালেই বাধা দেন এক স্টাফ। বলেন, মেডিসিনের রোগী এখানে না নেওয়ার নির্দেশনা আছে। রোবেদ আমিনের বরাতে কাজ হয়। ভেতরে শিশু ওয়ার্ডে নিতে রাজি হন। ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি সব বেডই খালি।

দৃশ্যপট-৪

৬টা বেজে ২৫। হাসপাতাল থেকে বেরোতেই শিশুটির চাচা আতোয়ার ফোন দেন। কথা হয় ওই ওয়ার্ডের মেডিকেল অফিসার মির্জা সাকির সঙ্গে। তিনি বলেন, এই ওয়ার্ডের ছয় বেডের আইসিইউ লকডাউন। সপ্তাহ আগে আইসিইউর একজন নার্স করোনায় আক্রান্ত হন। এরপর থেকে এটি বন্ধ। তিনি ভর্তি করতে প্রস্তুত। তবে তিনি হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বললাম, এটা ইফতারের সময়, অক্সিজেন দিতে পারবেন না? তিনি বললেন, ‘সেটা সম্ভব। আমরা অবশ্যই দেব।’ তখন তাঁকে আরও বললাম, অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছিলেন, এখানে শিশুদের জন্য ৪২ শয্যার আইসিইউ বেড আছে। সাকি বললেন, ‘সেটা শুধু অনধিক ২৮ দিন বয়সী শিশুদের জন্য। এই শিশুর বয়স ১ মাস ২৮ দিন। তাই ওখানে সম্ভব নয়।’ বললাম, দেশে একটা জরুরি অবস্থা চলছে। কোনোভাবে ম্যানেজ করা যায় কি না।

দৃশ্যপট-৫

১৭ মে। রাত ১টা ৫৮ মিনিট। আতোয়ার টেলিফোনে আমাকে বললেন, মেয়েটি নড়াচড়া করে না। ইসিজি করতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ৪০ মিনিটি ধরে ঘুরেছেন। পুরোনো ভবন থেকে নতুন ভবন, দোতলা থেকে তিনতলায় ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু শেষে জেনেছেন, ইসিজি হবে না। সব বন্ধ। লোক নেই।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ২টা ২৭ মিনিট। আতাউলের ফোন আসে। বলেন, সুমা মারা গেছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. তাহমিনা ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, এ রকম হার্টের বাচ্চাকে আইসিইউতে রাখা নিয়ম। তাঁরা সেটা জেনেবুঝে রিস্ক বন্ডে সাইন দিয়ে বাচ্চাকে ভর্তি করান। ৪২ শয্যার আইসিইউতে ভর্তি প্রসঙ্গে বলেন, ওটা শুধু অনধিক ২৮ দিনের বাচ্চাদের জন্য উপযোগী। চাইলেও ৫৮ দিনের এই বাচ্চাকে রাখা যেত না।বিজ্ঞাপন

দৃশ্যপট-৬

ভোর ৪টা ৩৬। আতাউলেরা সুমার মৃতদেহ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হন। সুমার ফুফুসহ সবারই আফসোস, তাঁরা যত্নটুকুও পেলেন না!

সুমার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা: হার্ট ফেইলিওর। মৃত্যুর সময়: ২টা ৩৫ মিনিট।

সুমাকে ১৭ মে সকাল ৯টায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানার সৈয়দপুরে দাফন করা হয়েছে।

দৃশ্যপট-৭

অধ্যাপক রোবেদ আমিন মনে করেন, সুমার জন্য আইসিইউ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। নিওন্যাটাল আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনীষা ব্যানার্জি এই প্রতিবেদককে জানান, যে সময়ে সুমা সেখানে ছিল, সে সময়ে নিওন্যাটাল আইসিইউয়ে ১৮টি শিশু সেবা পাচ্ছিল, বাকি আইসিইউ সুবিধাগুলো ছিল খালি। তবে তিনি মনে করেন, সুমার বয়স বেশি ছিল বিধায় তাঁর বিভাগে সুযোগ ছিল না। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র ফ্লোরিডার জ্যাকসনভিলে উলভসন চিলড্রেন হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেছেন, তাঁদের হাসপাতালেও তাঁরা দরকার পড়লে নিওন্যাটাল বিভাগের আইসিইউতে ২৮ দিনের বেশি বয়সী শিশুদের রাখেন। সুতরাং ২৮ দিনের বেশি বয়সী শিশুদের সেখানে রাখা যায় না, এ কথা সঠিক নয়।

১৮ মে

সুমা যে বিভাগের ভর্তি হয়েছে, অধ্যাপক ড. সাঈদা আনোয়ার সেই বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকস) প্রধান। আইসিইউ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বেও তিনি। জানতে চাইলে তিনি টেলিফোনে শিশুটির মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেন। বললেন, ২৮ দিনের বেশি বয়স হওয়ার কারণে নিওন্যাটাল আইসিইউতে তাকে ভর্তি করানো সম্ভব ছিল না। আর ছয় শয্যার আইসিইউর চারটিতে ভেন্টিলেটর আছে, দুটিতে নেই। এর একটিও সুমাকে দেওয়া সম্ভব ছিল কি না? অবহেলা ঘটেছে কি না? উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো তাকে দেখিনি। তবে আইসিইউ পায়নি বলেই মারা গেছে, সেটা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। হয়তো তার অবস্থা খারাপ ছিল।’ তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, খারাপ রোগীদেরও অনেক সময় তাঁরা ভর্তি করান। ঢাকা মেডিকেলে ২৮ দিনের বেশি বয়সের শিশুদের আইসিইউ সুবিধা প্রথম চালু হয় গত বছরের শেষার্ধে। তাঁর কথায়, এই মেয়েটির যদি শিশু কার্ডিওলজিস্টের দেখার দরকার পড়ত, তাহলে সেটা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, হাসপাতালে এই পদই নেই।

অধ্যাপক সৈয়দা আনোয়ার অবশ্য এ কথাও বলেন যে আইসিইউ পরিচালনার লোকবলেরও ঘাটতি আছে। ওই বিভাগে করোনা পজিটিভ পাওয়া এবং কোভিড বিভাগে লোকবল স্থানান্তরের কারণে এটা ঘটেছে।

তবে করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণে আইসিইউ লকডাউন রাখার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত দিয়েছেন। বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রিন্সিপাল, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার এবং হেড অব ইকুইপমেন্টস মেইনটেন্যান্স প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অবস্থায় আইসিইউ জীবাণুমুক্তকরণ (ফিউমিগেশন) করা দরকার পড়ে। আর সেটা একবার করলে দুই দিন এবং সন্দেহমুক্ত হতে চাইলে দ্বিতীয়বারে আরও দুই দিন, এই মোট চার দিন বন্ধ রাখলেই চলে।’

আইসিইউও কি মানুষ যে তাকেও ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে?

করোনায় আইসিইউ সংকট বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ সুবিধা অপরিহার্য। কিন্তু নন-কোভিড রোগী ছিল সুমা নামের মেয়েটি। অধ্যাপক সৈয়দা হয়তো ঠিক বলেছেন, আইসিইউ সুবিধা পায়নি বলেই সুমা মরেছে, তা হয়তো ধরে নেওয়া যাবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হওয়ার পর সাত দিন কেটেছে। জাতির এত বড় স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার মধ্যে যখন ‘আইসিইউ লকডাউন’ থাকে, দায়িত্বশীল কেউ যখন মুঠোফোনে বলেন, এখনো তো ‘চৌদ্দ দিন পার হয়নি’, তখন তা ভয়ানক নৈতিক দীনতা নির্দেশ করে। সরকার স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ালেও এই দৈন্য দূর হবে না।

তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। আতাউলের স্ত্রী মাকসুমার কোলে সুমার লাশ। আমি ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের গেটে তাঁদের বিদায় জানাই। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করি। ঢাকা মেডিকেল তো আসলে সুমাকে ভর্তি করাতেই চায়নি। হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে গেলে কি সুমা ঠাঁই পেত আইসিইউতে? আমি প্রায় নিশ্চিত, ডা. রোবেদের বরাত না দিলে ঢাকা মেডিকেলে তারা ঢুকতেই পারত না। গত কয়েক দিনে হাসপাতালগুলোয় ঘুরে শূন্য বেডগুলো দেখে বুঝেছি, নন-কোভিড রোগীদের সেখানে স্বাগত জানানো হলে বেডগুলো খালি পড়ে থাকত না।

তাই সুমার মৃত্যু ঠিক কোনো কিছুর দৈন্য নয়, এটা দণ্ডনীয় অবহেলার একটি উদাহরণ। সুমা নামের শিশুটি আমাদের রুগ্‌ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক অসহায় বলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *