অভিভাবকত্বের দায় নিয়ে ভাবনা শুরু হোক

কলাবাগানের স্কুলশিক্ষার্থী ধর্ষণ ও হত্যার ১৮ দিন আগে আরেকটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে ঘটনাটি পত্রপত্রিকা বা সামাজিক মাধ্যমের অগোচরেই রয়ে গিয়েছে। খুন হয়েছে ১৭ বছরের কিশোর। খুনি আপন পিতা, মাতা ও বোন। পিতা–মাতা খুন করেছেন নিজ পুত্রকে। যুক্ত হয়েছে বোনও। খুন করতে বাধ্য হয়েছে তারা। কারণ, সেই পুত্রের হাতে কন্যার সম্ভ্রমও নিরাপদ ছিল না। এই গা রি রি করা সংবাদটি দিয়ে কোনো লেখা শুরু করা মানসিকভাবে বিপর্যয়কর। কিন্তু অস্বস্তিকর সত্যকে এড়িয়ে গেলে সমস্যার সমাধান আসবে না, বরং আরও আরও অসংখ্য বিপদও চোখের আড়ালেই রয়ে যাবে। তাতে সমস্যা আরও বাড়বে।

এই খবরটির মূল ভাষ্য, বাংলাদেশের কৈশোর-তারুণ্য এক ভয়াবহ যৌন বিকৃতির পাকে খাবি খাচ্ছে। ভাই বোনকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে—এই বিষয়টি আর এড়িয়ে যাওয়ার পর্যায়ে নেই। পিতা-মাতা কতটা অসহায় হয়ে পড়লে আত্মজকে এবং বোন ভাইকে খুন করতে নামে—সেই আলোচনাটি এড়িয়ে না যাওয়াই দরকার। যমুনা টিভি অনলাইন-এর ৯ জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত সংবাদে ছাপা খবরের শিরোনাম ‘মেয়েকে ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে ছেলেকে হত্যা করল বাবা–মা’।

খবরে লেখা হয়েছে, গত ২১ ডিসেম্বর ঘটনার রাতে নিহতের ছোট বোন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হলে ভাই তাকে নিজের ঘরে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। মেয়ের চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে পিতা ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে ছেলেকে ধরে তার মুখে বালিশ চাপা দেয়, মা পা ধরে রাখে। এ সময় ছোট বোন ছুরি দিয়ে ভাইয়ের পুরুষাঙ্গ কেটে হত্যা করে। পরে তারা সবাই বাড়ির পাশের ডোবায় লাশ ফেলে দেয়।


এই হত্যাকাণ্ড দুটির পেছনের কারণের মতো আরও কত কত কৈশোর-তারুণ্যের যৌনাচরণ-বিপর্যয় যে আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে যাচ্ছে, কে জানে! অভিভাবকত্ব কী অবস্থায় আছে, অভিভাবকত্বের দায় কী—এই সব প্রশ্ন এখন আর না ওঠানোর সুযোগ নেই। পরিবার ও সংসার কাঠামোয় নানা রকম বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। যেহেতু পরিবারই সমাজের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ও মূল সামাজিক সংগঠন, কৈশোর-তারুণ্যের স্খলন বিষয়ে পরিবারকেন্দ্রিক আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হওয়া দরকার। প্রথম আলোয় আগের একটি লেখায় ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গবেষক সুসান হেরিং-এর ২০০৮ সালে দেওয়া ‘প্রজন্মের খণ্ডিতাবস্থা’ বা ‘জেনারেশনাল ডিভাইড’ ধারণাটি নিয়ে লিখেছিলাম। সুসানের বক্তব্য ছিল যে অভিভাবক এবং সন্তানেরা দুটি খণ্ড হয়ে পড়ছে। তিনি আরও জানান, এই ‘ডিভাইড’ বা খণ্ডাবস্থা নিরসনের দায় যে অভিভাবকদেরই বেশি—সে সত্যটি সন্তান এবং অভিভাবক উভয় পক্ষই মানে। পরিবারভিত্তিক নৈতিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা এবং চর্চার দায়ভার অবশ্যই অভিভাবকত্বের।


যৌন-আগ্রাসী সন্তান নিশ্চয়ই এক দিনে তৈরি হয় না। ধর্ষণের মতো অপরাধের শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড, সেটি এখন আর কিশোর-কিশোরীদেরও অজানা নেই। অনৈতিক যৌনাচরণের ঝুঁকি নিতে তবু যারা পিছপা হয় না, আশঙ্কা করা অমূলক নয় যে তারা আরও বিভিন্ন রকম অপরাধ ও স্খলনের নানা পর্ব বহু আগেই পার করে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ছড়াছড়ি। সেগুলোতে কৈশোর-তারুণ্যের স্খলন ও বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে নানা রকম বক্তব্য আছে। পর্নোগ্রাফি, মাদক, ইয়াবা, যৌন উত্তেজক ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা, নৈতিক ও ধর্মশিক্ষাবিযুক্তি, সুস্থ যৌনস্বাস্থ্য-শিক্ষাহীনতা, বিকল্প বিনোদনের অভাব, ভোগবাদ ইত্যাদি অসংখ্য মতের ছড়াছড়িই আছে বলা চলে।

এসবের বাইরে অন্যতম প্রধান যে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে, সেগুলো—এক, প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের পতন ও অভিভাবকত্বের বেহাল অবস্থা। দুই, অপরাধীদের অভিভাবকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি। তিন, সন্তান ও অভিভাবক উভয়েরই কলুষিত রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা। চার, বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতা, সুবিচারের অভাব এবং প্রচলিত বিচার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রতি নাগরিকের আস্থাহীনতা। এবং পাঁচ, সামাজিক প্রতিরোধব্যবস্থার বিনাশ। সবগুলো মন্তব্যের সাধারণ সারমর্ম এই যে অভিভাবকত্বের ধ্রুপদি দিনগুলো আর নেই। অভিভাবকেরা তাঁদের উত্তর প্রজন্মের অবাধ্যতা আর মাত্রাছাড়া স্বাধীনতা-প্রত্যাশার মুখে ভয়ে ভয়েই থাকেন। ভয়ে থাকার আরও একটি অন্যতম বড় কারণ অভিভাবকদের বড় অংশের স্খলন সন্তানেরা নিত্যই চাক্ষুষ করছে। ফলে অভিভাবকেরা তাঁদের কাছে আর রোল মডেল বা অনুকরণীয় শ্রদ্ধাভাজন চরিত্র মোটেই নন।
বিজ্ঞাপন

যখন পিতা–মাতা শতভাগ নিশ্চিত, সন্তানটি অপরাধ করেছে এবং সে প্রাপ্তবয়স্ক, তাঁদের কি কর্তব্য যাবতীয় মিথ্যা তথ্য ও প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে সন্তানকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দেখানোর চেষ্টা করা? অথবা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি এবং আর্থিক সামর্থ্য থাকায় আইন বা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা?


কল্পনা করা যাক যে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত দিহানের পিতা–মাতা প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করছেন। নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা বিচারব্যবস্থায় বিন্দুমাত্রও প্রভাব বিস্তার করবেন না। দেশের আইনে সুবিচারের জন্য যে রায়ই হবে, তাঁরা মেনে নেবেন। সন্তান বলে তাঁরা দেশের মঙ্গলের চিন্তা বাদ দেবেন না। আরও লাখো নারীর যৌন নিরাপত্তা তাঁদেরও চাওয়া। ধরা যাক, কলাবাগানের ধর্ষণের শিকার স্কুল ছাত্রীর পিতা–মাতাও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সুবিচার ছাড়া আর কিছুই চান না। প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধস্পৃহা নয়, তাঁরা চান দৃষ্টান্তমূলক সুবিচার, যাতে আর কোনো নারীকে বীভৎসতার শিকার না হতে হয়। কল্পনা করা যাক, মাধ্যমিক স্কুলগুলোর শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সদস্যরাও রাস্তায় নেমে এসেছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরাও সামাজিক অভিভাবক এবং ঘোষণা দেন যে তারুণ্যের নৈতিক স্খলন বন্ধে রাষ্ট্রকে যত রকমের সহায়তা দেওয়া দরকার, দেবেন। দাবি জানাচ্ছেন যে রাষ্ট্রও সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসুক।

এ রকম কল্পনা করাই যায়, কারণ সেগুলো মোটেই অবাস্তব কল্পনা নয়। চাইলেই কল্পনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব। সন্তানের প্রাণ রক্ষার জন্য, সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য পিতা–মাতার চেষ্টা থাকবেই। আইনও সব নাগরিককে সেই সুযোগটি দেয়। আইনের মূল ভাষ্যই হচ্ছে অপরাধ যতক্ষণ পর্যন্ত সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধীকে নির্দোষ ধরা হবেই। এখন প্রশ্ন ওঠা দরকার, অভিভাবকত্বের নাগরিক দায় বিষয়ে। যখন পিতা–মাতা শতভাগ নিশ্চিত, সন্তানটি অপরাধ করেছে এবং সে প্রাপ্তবয়স্ক, তাঁদের কি কর্তব্য যাবতীয় মিথ্যা তথ্য ও প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে সন্তানকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দেখানোর চেষ্টা করা? অথবা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি এবং আর্থিক সামর্থ্য থাকায় আইন বা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা? কিংবা সন্তানের নৈতিক স্খলনের পক্ষে দাঁড়ানো? দিহানের বয়স কমিয়ে দেখানো, তার মায়ের অনুশোচনাহীনতা, সন্তানের পক্ষ নিয়ে নিত্যনতুন মন্তব্য ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমকে নানা রকম প্রশ্ন-উত্তরে সরগরম রেখেছে। দিহানের আরেক ভাইয়ের হাতেও আরেকজন নারীর মৃত্যুর ঘটনা রটনা সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। অভিভাবকত্বের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার কলাবাগানের স্কুল ছাত্রীর পিতা–মাতাকেও।

অভিভাবকত্ব আলোচনার দুটি স্পষ্ট মাত্রা আছে। একটি আইনগত। আরেকটি নৈতিক। আইনগত দিকটি কেউই অস্বীকার করছে না যে অভিযুক্তের পক্ষে অভিভাবকদের আইনগত ও বিচারিক সেবা এগিয়ে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। নৈতিক বিষয়টির উত্তর সহজ না হলেও প্রশ্ন আসতেই হবে। কারণ, অভিভাবকদের নাগরিক দায় এবং দায়িত্বও নিশ্চয়ই আছে! কারণ, তাঁরা সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।

কয়েক শ বছর আগেই হবস, লক, রুশো প্রমুখ ‘সমাজ’ চিনিয়েছিলেন দায়বদ্ধতার একটি দলিল বা ‘চুক্তি’ হিসেবে। এই অলিখিত চুক্তির মূলকথা এই যে সমাজে মানুষ শুধু জন্মেই স্বাধীন। জন্মানোর পর সবকিছুতেই মানুষের পায়ে বেড়ি আঁটা থাকে। সেই বেড়ি নিয়মশৃঙ্খলার, নীতি-নৈতিকতার এবং সীমা লঙ্ঘন না করতে পারার বেড়ি। সব ধর্মগ্রন্থগুলোর একটি মৌলিক শিক্ষাও সেরকমই—কেউ যেন সীমা লঙ্ঘন না করে।

অভিভাবকত্ব যখন উত্তর প্রজন্মকে হত্যায় বাধ্য হয়, অথবা উত্তর প্রজন্মকে আচরণের সীমারেখাটি বা বেড়িটি দেখিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়, তখন আর অপেক্ষার অবকাশ থাকে না যে অভিভাবকত্বকেও ব্যর্থতার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার। কলাবাগানের স্কুলছাত্রী হত্যাকে উপজীব্য ধরে হলেও অভিভাবকের দায়-ভাবনা শুরু হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *