ধর্ম অবমাননা আইন ঘিরে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ : আন্দোলনে ইসলামী দলগুলো
রাজনৈতিক প্রতিবেদক
২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী আন্দোলন। পরবর্তীতে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্রুত ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় ও দৃশ্যমান উপস্থিতি এবং উন্মাদনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—ইসলামী শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ। এসব গোষ্ঠী ধর্ম অবমাননা সংক্রান্ত বিদ্যমান ফৌজদারি আইনকে আরও কঠোর করার দাবি জানাচ্ছে এবং বর্তমানে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করার জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দৈনিক যুগান্তর-এ প্রকাশিত ২০২৫ সালের ৪ঠা অক্টোবরের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, কুরআন অবমাননার অভিযোগে অপূর্ব পাল নামে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ৪ঠা অক্টোবর রাতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে এবং ধর্ম অবমাননার ঘটনায় আনুষ্ঠানিক মামলা করার প্রস্তুতির কথাও জানায়।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠী ও ধর্মীয় নেতারা আরও কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি তোলেন। বিশেষ করে ধর্মীয় বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ প্রকাশ্যে দাবি করেন—ধর্ম অবমাননার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের দাবি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ২০২৬ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেক্যুলার মতাদর্শী, মুক্তচিন্তক ও মৌলবাদবিরোধী লেখক-ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় আবেগ উসকে দেওয়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও ধর্মীয় বক্তৃতায় মুক্তমত প্রকাশকে ‘ধর্ম অবমাননা’ হিসেবে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট লেখকদের সর্বোচ্চ শাস্তি—মৃত্যুদণ্ড—দাবি প্রকাশ্যে উত্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রবণতা সমাজে ভীতির পরিবেশ তৈরি করছে এবং ভিন্ন মতের মানুষদের হত্যায় প্ররোচিত করছে। ইসলামী রাজনীতির এই ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে সেক্যুলার বা মৌলবাদবিরোধী লেখক, ব্লগার ও অনলাইন কমেন্টেটরদের ওপর হামলার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যদিও এসব হামলা পরিকল্পিত কি না—সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে, তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, হামলাকারীদের পোশাক, আচরণ ও বক্তব্যে তারা কোনো না কোনো ইসলামপন্থী উগ্র সংগঠনের অনুসারী বলে মনে হয়েছে।
ধর্মীয় মৌলবাদ এবং ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব বলয়ের উত্তোরত্তর এই প্রসারণ এর উদাহরণ হিসেবে ধর্মীয় অবমাননার জের ধরে ফৌজদারী অভিযোগের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাত্রা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে এবং এগুলোর শিকার মূলত অন্তর্জালে প্রকাশিত মতামতকারীরা; একই সাথে, এ বিষয়গুলোতে সমালোচনামূলক লেখালিখি অন্তর্জালে প্রকাশিত করবার কারণে বিবিধ প্রকাশনা এবং লেখকদের বা তাদের পরিবারের ওপর সরাসরি হামলার ঘটনাও তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গোটা দেশজুড়ে। উদাহরণস্বরূপ মেহেরপুরের রুমানা পারভীন, কুষ্টিয়ায় মোসাম্মাত নাসরিন সুলতানা, জালালপুরে বুরহান উদ্দীন, সিলেটের নুরুল আমিন, দক্ষিণ সুরমার মুনায়েম আহমেদ এবং মোহাম্মাদ শহীদুল ইসলাম জায়গীরদার, চাঁদপুরের মোঃ রাজিম হোসাইন, শরীয়তপুরের মোঃ জাকির হোসাইন, খুলনার গাজী আফতাবুননেসা রিতি, দিনাজপুরের মোঃ মিজানুর রাহমান, কুমিল্লার গাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামসহ প্রমুখ এর পরিবার এইধরণের আক্রমণের শিকার বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী, হামলার পর থানায় মামলা করতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে “সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এমন লেখালেখি থেকে বিরত থাকার” পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত পরিবারগুলোর বক্তব্য—নিজস্ব মত প্রকাশের কারণে একজন লেখকের পরিবার কেন হামলার শিকার হবে এবং রাষ্ট্র কেন তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে—তা তাদের বোধগম্য নয়।
আক্রান্ত লেখকদের একটি বড় অংশ দৈনিক নবযুগ, এথিস্টনোট, এথিস্টএরা এবং এথিস্ট ইন বাংলাদেশ নামক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে জানা যায়। এসব ওয়েবসাইট এবং একই ধরণের অন্যান্য প্রকাশনাকে কেন্দ্র করেই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
