বিনা টাকায় পণ্য মেলে যে স্টোরে

এ যেন প্রাচীন আমলের বিনিময় প্রথা! এক শ টাকায় সুতি থ্রি পিছ কিনলেন পোশাককর্মী তাসনূর। বিছানার চাদর, মাথার ব্যান্ড, আংটি, কাচের গ্লাস, পুতুলসহ মোট ৩০০ টাকার কেনাকাটা করে হাসিমুখে বের হলেন তিনি। তবে এতে কোনো টাকা খরচ হয়নি তাঁর।

পাঁচ বছর বয়সী সন্তানের মা তাসনূরের স্বামী অটোরিকশা চালান। নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ তিনি। গত বৃহস্পতিবার কেনাকেটা করতে এসেছিলেন রাজধানীর মিরপুরে (সেনপাড়া, পর্বতা) অদল–বদল স্টোরে। এটি নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের জন্য পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কেনার দোকান। পরিচালনায় আছে বেসরকারি সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।

এ স্টোরের প্রাণ ক্রেতা–বিক্রেতা নয়; দাতা–গ্রহীতা। তাঁদের মধ্যে ঘটে পণ্যের অদল-বদল। দাতা তাঁর ব্যবহার করা (ব্যবহার উপযোগী) বা বাড়তি পণ্য ওই ফাউন্ডেশনকে দান করে দেন। পরে ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা তা ধুয়ে, ইস্তিরি করে, প্যাকেট করে স্টোরে সাজিয়ে রাখেন। আর এসব পণ্য যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা নিয়ে যাচ্ছেন হাসিমুখে।

অদল–বদল স্টোরের আরেক বৈশিষ্ট্য, এখানে টাকার বিনিময়ে পণ্য কেনা যায় না। তাসনূরকে ৩০০ টাকার সমমূল্যের তেল, লবণ, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য ওই দোকানে সরবরাহ করতে হয়েছে। এরপরই তিনি তাঁর চাহিদামাফিক পণ্য নিতে পেরেছেন। তাঁর দেওয়া এই তেল, চাল, ডালসহ বিভিন্ন পণ্য বিদ্যানন্দের ‘এক টাকায় আহার’ কার্যক্রমে ব্যবহার করা হবে।

অদল–বদল স্টোরে পণ্য বিনিময় করতে আসেন অনেকে
অদল–বদল স্টোরে পণ্য বিনিময় করতে আসেন অনেকে

অদল–বদল স্টোরের এমন ব্যতিক্রমী কার্যক্রম আপাতত ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের স্টোর স্থায়ী হলেও ঢাকারটি শুরু হয়েছে অস্থায়ীভাবে এক মাস হলো। ভালো সাড়া পাওয়া গেলে এটিও স্থায়ীভাবে চালানো হবে। সম্প্রসারণ করা হবে এই কার্যক্রম।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক সুলতানা জান্নাত জানান, গত এক মাসে প্রায় সাত হাজার টাকার সমমূল্যের পণ্য বিক্রি হয়েছে এসব স্টোরে। পোশাককর্মী, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ পণ্য অদল–বদল করছেন। দেখতেও আসছেন অনেকে।

মিরপুর ফলপট্টির উল্টো দিকে সাজেদা ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় ছিমছাম করে সাজানো অদল–বদল স্টোর। ক্রেতাকে স্টোরের মূল ফটকে ব্যাগ জমা রেখে ঢুকতে হয়। স্টোরে স্বেচ্ছাসেবক থাকেন সহায়তার জন্য। স্টোরে কনের জন্য বেনারসি ও কাতান, বরের শেরওয়ানি সাজিয়ে রাখা আছে। শার্ট, কোট, টাই, শাড়ি, সালোয়ার–কামিজ, পানির ফিল্টার, ব্যাগ, শোপিচ, হাঁড়িপাতিল, বই, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে একটি কম্পিউটারও আছে।

সুলতানা জান্নাত বললেন, বিয়ের শাড়ি আছে ছয়টি। তিনি নিজের একটি বিয়ের শাড়িসহ কয়েকটি শাড়ি দিয়েছেন এ স্টোরে। বিয়ের শাড়ি বা বরের শেরওয়ানি কিনতে হলে বিয়ে হবে সেই প্রমাণ দিতে হবে। একইভাবে কম্পিউটার কিনতে কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, আসলেই প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রমাণ দিতে হবে। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিয়ের শাড়ি ২ হাজার টাকা মূল্যের সমপরিমাণ পণ্যের বিনিময়ে পাওয়া যাবে এখানে।

শিশুদের খেলনাও আছে 
ওদল-বদল স্টোরে
শিশুদের খেলনাও আছে ওদল-বদল স্টোরে

এ স্টোরে দিনে একজন ৫০০ টাকার বেশি (বিয়ের শাড়ি বা বিশেষ পণ্য ছাড়া) কেনাকাটা করতে পারবেন না। আবার ৫০০ টাকা সমমূল্যের সব কাচের গ্লাস একজন নিয়ে নেবেন তা–ও হবে না। একজন এভাবে মাসে দুবার কেনাকাটা করতে পারবেন।
দাতার দেওয়া পণ্য একেবারে নতুন না কিছু পুরোনো, তার ভিত্তিতে পণ্যের গায়ে দাম (স্বল্পমূল্য) লেখা হয় বলে জানান সুলতানা জান্নাত। তবে ক্রেতার সম্মানের কথা চিন্তা করে একেবারে বিনা মূল্যে পণ্য দেওয়া হয় না।

নিজের বিয়ের সময় পছন্দ করে কেনা শাড়িসহ বিভিন্ন শাড়ি স্টোরে দেওয়া প্রসঙ্গে সুলতানা জান্নাত বলেন, এক–দুই হাজার টাকায় কেউ হয়তো নতুন শাড়ি কিনতে পারবেন। কিন্তু বিয়েতে একটু কমলা বা লাল কাতানের যে স্বপ্ন থাকে, তা এ দামে কেনা সম্ভব নয়। অদল–বদল স্টোরে এসে সেই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব। এখানে হাতের নাগালেই থাকে দামটি। তিনি আরও বললেন, ‘বিয়ের বা যেকোনো শাড়ির সঙ্গেই কারও আবেগ মিশে থাকে। আমার আবেগ আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করার সুযোগ পাচ্ছি। একজনের স্বপ্ন পূরণ হলে তা আমার অবশ্যই ভালো লাগবে। যে চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যাওয়ার আগে এখান থেকে শার্ট, কোট বা টাই নেবেন, তিনি যখন চাকরি পাবেন, তা অবশ্যই আমাদের বিরাট পাওনা। অনেকেই আছেন—সাক্ষাৎকার দিতে যাওয়ার আগে ভালো একটি শার্ট কিনতে পারেন না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *