ভাই এত ভয়ংকর!
বাবু ও ইমু দুই ভাই। তাঁদের বড় বোন সামছুন্নাহার, লুৎফুন নাহার ও আয়েশা। ছোটবেলা থেকেই তাঁরা মায়ের চেয়েও বেশি সময় থাকতেন বোনদের কাছে। মুখে তুলে খাওয়ানো, গোসল করিয়ে দেওয়া কিংবা ঘুম পাড়ানো সব দায়িত্বই পালন করতেন বড় বোনরা। ১৯৮৪ সালে সবার বড় বোন সামছুন্নাহারের যখন বিয়ে হয়, তখন বাবুর বয়স ছিল সাড়ে চার বছর, আর ইমুর তিন। মমতাময়ী মায়ের মতো তিন বোন আগলে রাখতেন ছোট ভাইদের।
কিন্তু যে ভাইদের কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন, মুখে তুলে খাবার খাইয়েছেন, সেই বদর উদ্দিন আহম্মেদ সিদ্দিক ওরফে বাবু ও নুরে আলম সিদ্দিক ওরফে ইমু এখন ‘অমানুষে’ পরিণত হয়ে গেছেন। নানাবাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তি মা তহুরা সিদ্দিকা লিখে দিয়েছেন মেয়েদের। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বোন ও তাঁদের পরিবারকে বাবু-ইমু খুনের হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে আহত করেছেন বড় বোন সামছুন্নাহারকে। শত কোটি টাকার জমি দখল করেই ক্ষান্ত হননি বাবু ও ইমু, গর্ভধারিণী মায়ের ওপর চালিয়েছেন অমানুষিক নির্যাতন। তাঁরা ওই জমি ফেরত পেতে ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মাকে এমন মার দেন যে মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আঘাতে এ সময় মায়ের পা ভেঙে যায়। এ ঘটনায় মা বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় বাবু ও ইমুর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। পরে ২০১৯ সালে মা তহুরা সিদ্দিকা মারা যান। সেই মামলা আদালতে এখনো চলমান।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, আবু বকর ও তহুরা খাতুন দম্পতির আট সন্তান। তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। ১৯৮৭ ও ২০১৭ সালে নানাবাড়ি থেকে পাওয়া মিরপুরের ২৮.৬২ শতাংশ জমি মা তহুরা খাতুন পরিবারের সব সদস্যের সম্মতিতে পাঁচ মেয়েকে দান করে দেন। সব কিছুই ঠিকভাবে চলছিল আবু বকর পরিবারের। সময় পেরিয়ে সেই ছোট বাবু ও ইমু বড় হন। এরই মধ্যে বাবা মারা যান। মায়ের দেওয়া জমি থেকে বোনদের উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হননি, জোরপূর্বক মিরপুরের ৬৪ নম্বর বড়বাগে তাঁদের পৈতৃক ২৭ শতাংশ জমির বাড়ি, যে বাড়িতে বোনদের বেড়ে ওঠা ও বিয়ে, সেই বাড়িতেও তাঁদের ঢুকতে দেন না ভাইয়েরা। শুধু পৈতৃক ভিটা থেকে বঞ্চিত করাই নয়, সাভারে ৩০ বিঘা ও গাজীপুরে ৩৫ বিঘাসহ প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি থেকে বোনদের বঞ্চিত করেছেন ওই ভাইয়েরা। জমির কাছে গেলে পুরো পরিবারকে খুন করা হবে বলেও ভাইদের সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে নিয়মিত।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরপুর বড়বাগে ২৮.৬২ শতাংশ জমি (৭২ নম্বর প্লট) সিএস রেকর্ড অনুসারে জমির মালিক সৈয়দ মোহাম্মদ মারা গেলে হাজি সুরুজ্জামান তাঁর ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হন। হাজি সুরুজ্জামানের কাছ থেকে ১৯৮০ সালের ২৯ জুলাই তহুরা খাতুন কিনে নেন, যা কাগজপত্রেও তহুরা খাতুনের নাম রেকর্ডভুক্ত হয়। পরবর্তী সময় তহুরা খাতুন তাঁর কেনা সম্পত্তি থেকে ১৯৮৭ ও ২০১৭ সালে দুই দফায় তাঁর মেয়ে সামছুন্নাহার সিদ্দিকা, আয়েশা সিদ্দিকা, লুৎফুন নাহার সিদ্দিকা, কামরুন নাহার সিদ্দিকা ও বদরুন নাহার সিদ্দিকাকে রেজেস্ট্রি করে লিখে দেন, যা ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি হেবা দলিল মূলে তাঁদের নামে নামজারি (নম্বর-৪৩০১/১৬-১৭) হয়। ওই জমির পাশেই মিরপুরের ৬৪ নম্বর বড়বাগে তাঁদের পৈতৃক ২৭ শতাংশ জমি রয়েছে। কিন্তু তা জোরপূর্বক দখল করে বোনদের বঞ্চিত করে ভোগদখল করছেন তিন ভাই।
বোনদের জমি লিখে দেওয়ার পর থেকেই মা তহুরা খাতুনের ওপর একের পর এক নির্যাতন চলে। মারধর, খাবারের কষ্টসহ নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে যান ইমু ও বাবু। সেই কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বড় বোন সামছুন্নাহার সিদ্দিকা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিজের কেনা সম্পত্তি আমাদের পাঁচ বোনকে লিখে দেন মা। সেই জমিতে আমরা ভবন করে ভাড়া দিয়েছি ৩৫ বছর ধরে। কিন্তু সেই জমি জোর করেই দখলে নিয়ে গেল ওরা। জমিতে যাওয়ার পর ভাইদের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা হামলা করল। ভাইদের নামে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছি। ওরা এখন হুমকি দিয়ে বলে, জমির কাছে গেলে নাকি পরিবারসহ মেরে ফেলবে। যাদের কোলে-পিঠে করে বড় করলাম, সেই আদরের ভাই জমির জন্য খুন করতে চায়।’
আরেক বড় বোন আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘আমার বৃদ্ধা মাকে শুধু জমির জন্য ওরা অনেক নির্যাতন করেছে, মেরে ফেলার জন্য সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে আহত করে। ওই ঘটনায় আমার মা বাদী হয়ে থানায় মামলাও করেছিল। যারা সম্পদের জন্য নিজের মাকে মেরে ফেলতে চায়, তারা বোনদেরও মেরে ফেলতে পারে। শুধু মায়ের দেওয়া জমিই নয়, বাবার নামে বড়বাগের শত কোটি টাকার জমি, সাভার ও গাজীপুরের জমিও তিন ভাই দখল করে রেখেছে। সেই জমির আনুমানিক মূল্য দুই শ কোটি টাকার বেশি। সেই সম্পত্তির অংশীদারও আমরা, কিন্তু সেই সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে ভাইয়েরা।’
আরেক বড় বোন লুৎফুন নাহার সিদ্দিকা বলেন, ‘স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির মদদে ছোট ভাই ইমু ও বাবু আমাদের জমি দখলে নিয়ে এখন আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। ভাইয়েরা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে শুধু জমির কারণে। বাবার যে বাড়িটিতে আমরা বড় হয়েছি, সেই বাবার বাড়িতে এখন ঢুকতে দেয় না’—বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
বোন সামছুন্নাহার সিদ্দিকা বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভাই মো. বদর উদ্দিন আহম্মেদ সিদ্দিক ওরফে বাবু, নুরে আলম সিদ্দিক ওরফে ইমু ও আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেন।
পারিবারিক বিভিন্ন সূত্র আরো জানায়, সাভার ইউনিয়নের শিষারচরে ৩০ বিঘা এবং গাজীপুরের মির্জাপুর উপজেলার মনিপুর মৌজায় ৩৫ বিঘা পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে। সেখানেও বোনরা সব সম্পত্তিতে ওয়ারিশ সূত্রে মালিকানা অংশীদার, কিন্তু তাঁদের ভাইয়েরা জোর করে দখল করে রেখেছেন।
প্রতিবেশী সিরাজুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম ও আরিফুজ্জামান জানান, কয়েক যুগ ধরে জানি তাদের মা তিন বোনকে ২৮ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছেন এবং সেখান থেকে এত দিন ভাড়া বোনেরাই খেয়েছে। কিন্তু সেই জমি থেকে এখন বোনদের উচ্ছেদ করেছে ভাইয়েরা। জমির জন্য মায়ের ওপরও নাকি নির্যাতন চালিয়েছে ইমু আর বাবু। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষ এসবকে মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বদর উদ্দিন আহম্মেদ বাবুর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ শুনে কালের কণ্ঠকে বলেন, আপনাকে এসব কে বলেছে? আপনি আমার নম্বর পেলেন কোথা থেকে? আর এগুলো দিয়ে আপনি কী করবেন? বলেই লাইনটি কেটে দেন। এরপর আরেক ভাই নুরে আলম সিদ্দিককে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও কল রিসিভ করেননি।