‘অনন্ত জলিল দু’টি হ্যাংগিং ব্যাজ ঝুলিয়েছেন, ববি গিট মেরে পুলিশের পোশাক পরেছেন’
‘হিন্দি চলচ্চিত্রে পুলিশ’ এই শিরোনামটি যখন মাথায় আসে তখন আপনার মাথায় আসে, হয় সিংহামের অজয় দেবগন, নয়তো দাবাং এর সালমান খান অথবা রাউডি রাঠোর এর অক্ষয় কুমার! একদম সাম্প্রতিক বিস্মৃতির অতল তল থেকে উঠে আসতে পারে গঙ্গাজলের প্রিয়াংকা চোপড়া কিংবা দৃশ্যাম এর টাবু!
হিন্দি চলচ্চিত্রে অসাধু চরিত্রের পরাজয় বারংবার দেখানো হয় সৎ ও সাধু পুলিশের কাছে। এটি একটি বার্তা দেয়, যে ভাল-মন্দের উপস্থিতি সর্বত্র! কিন্তু দিনশেষে সিস্টেম ও ভালটুকুই জয়ী হয়! তারা মাথায় রাখেন ভাল না থাকলে কোনো সিস্টেম টিকে থাকতে পারে না! তাই বলে অসাধু চরিত্রের পুলিশের উপস্থাপন কি হচ্ছে না, হবে না? অবশ্যই হয় এবং হচ্ছে! যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রে তা কি হয়ে আসেনি? যদিও অন্য অসাধুদের ফুটিয়ে তুলতে আমাদের মিডিয়ার যারপরনাই আপত্তি, কারণ পুলিশকে দিয়ে অতিরঞ্জন করা গেলে এবং যা ইচ্ছে তাই বলা গেলে, কোনো সমস্যা হয় না! এটি মোটামুটি দিনের আলোর মত স্বচ্ছ।পুলিশ ভাল করতে চাইলে, পরিবর্তনের ধ্বনি উড়াতে থাকলেও কোনো বিষয় না, তাদের বারবার হেয় করার চেষ্টা করা হবে তাদের কতিপয় সদস্যদের আচরণ দিয়ে! বলবে এখন ভাল করছেন বুঝেছি, কিন্তু আপনাদের অমুক যে এটা করলো অথবা করেছিল তা নিয়েও কিছু বলুন! এভাবেই দিনের পর দিন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে মেয়েগুলো যারা পরিবর্তনের ধ্বনি শোনাতে এই বিভাগে আসেন, বারবার তাদের হৃদয়ে আঘাত করা হয়! ভাবখানা এমন যে, বিশুদ্ধতায় মোড়া আমাদের এই বঙ্গে একমাত্র পুলিশই সব খারাপের মূল, বাকি সকলে এইমাত্র গঙ্গাজলে স্নান করে শুদ্ধতার মূর্ত প্রতীক হয়ে এসেছেন।
আচ্ছা এবার এক কাজ করুন দেখি, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পুলিশ’ এটি একটু ভিজ্যুয়ালাইজ করুন, চোখে কি ভেসে আসে? শ্রদ্ধেয় অমল বোসের বড় পেট, শ্রদ্ধেয় দিলদারের কান চুলকানো তথা হ্যাকলিং অথবা মিশা সওদাগরের খল চাহনি, রাজীব, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদের মত খলঅভিনেতাদের মুখচ্ছবি ভেসে আসছে তাই তো? যুগের পর যুগ বাংলাদেশের ফিল্মে পুলিশের উপস্থাপন এরকমটিই হয়েছে! ফিল্মের শেষে এসে পুলিশ বলছে, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট অথবা আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না! তো আমরা যারা হাজারে হাজারে ঘটনার নিষ্পত্তি করছি, তারা কোথায়? আমাদের সুশিক্ষিত, স্মার্ট অফিসাররাই বা কোথায়? এক ঢাকা অ্যাটাক চলচ্চিত্র ছাড়া পুলিশের যথার্থ উপস্থাপনটুকুই তো হয়নি এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে!
যুগের পর যুগ এ দেশের চলচ্চিত্রে পুলিশের ইউনিফর্মটিকে পর্যন্ত সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি! অনুমতি নেয়ার বিষয়ে নীতিমালা থাকলেও তার ফাঁক গলে অনেকেই আবোল তাবোল পোশাকে পুলিশকে উপস্থাপন করেছেন। অন্যদের কথা বাদই দিলাম, অনন্ত জলিল এক সাথে দুটি হ্যাংগিং ব্যাজ ঝুলিয়েছেন, নায়িকা ববি গিট মেরে পুলিশের পোশাক পরেছেন, টুপি ছাড়া হাঁটু তুলে, হাত দিয়ে স্যালুট সেতো আর বলতেই নেই! অনৈতিক কাজে লিপ্ত কিছু অসাধু সদস্যকে তুলে ধরা হয়েছে, আবার কখনো কখনো ভাল কর্মকর্তার উপস্থিতিও এসেছে তবে তা খুবই ক্ষীণ হারে! কিন্তু পুলিশ বলতেই পেট মোটা অথবা খল চেহারার মুখচ্ছবিই আমাদের চোখে ভেসে আসে বারবার। এর মানে হচ্ছে, আমাদের জীবনের দর্পণ, আমাদের শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র, পুলিশ মানেই এমন খল মুখাবয়বের হয়, সেটি মোটামুটি সেট করেই দিয়েছেন! এসব নিয়ে তাদের কিছুই বলা হয়নি, মানে এই নয় পরবর্তী সময়ে বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন দিয়ে সামগ্রিক সিস্টেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরও, একজন ভিকটিমকে বিপদে থানার দ্বারস্থ হতে নিরুৎসাহিত করার পরও, বিশেষ কোটার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে না!
নারীকে কেউ পণ্য তথা ফলের সাথে তুলনা করার পর আমরা চরম আক্রোশে ফেটে পড়ি, আমরা প্রতিবাদ করি! যা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত! আর নারীকে শিল্পের নামে অশ্রাব্য ভাষায় নগ্ন উপস্থাপনে আমাদের শিল্পিত বোধ তথা অহমে একটুও আঘাত লাগে না বরং আমাদের তথাকথিত সুশীলগণ স্বাধীনতার নামে এখানে নারীর বিরুদ্ধে কোনো অবমাননাই খুঁজে পান না! সেটি তখন চলচ্চিত্রের স্বাধীনতা হয়ে যায়! অথচ নবাব এলএলবি’র এই কথোপকথন যে গ্রামের একজন ভিকটিমকে নানাভাবে বিপদে পড়ার পরও থানায় আসতে নিরুৎসাহিত করতে পারে, তা সম্পূর্ণ সুশীলতায় মোড়ানো ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণ উপলব্ধিও করতে পারছেন না!
এটি যে একটি সিস্টেমকে এবং সেই সিস্টেমের সাথে জড়িত হাজারে হাজারে সৎ কর্মকর্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে তাও ভাবছেন না! যে মেয়েটি সমস্যায় পড়েনি কিন্তু ভবিষ্যতে পড়তে পারেন, তার জন্য কি নায়করুপী নবাব এল.এল.বি দাঁড়াবেন নাকি সিস্টেম দাঁড়াবে? নায়ক সাহেব তো চলচ্চিত্রের ব্যবসা দিয়েই শেষ, কিন্তু সবশেষে এটি যে, একটি বাজে উদাহরণ সেট করে, আমাদের ভুক্তভোগী নারীকে পিছিয়ে দিচ্ছে এবং একইসাথে নারীর প্রতি জঘন্য অবমাননাও হয়ে যাচ্ছে তাতে এখন কারো আঁতে ঘা লাগছে না! কেন লাগছে না? শিল্পের নাম লেগে আছে বলে? শিল্প মানেই বুঝি যা ইচ্ছে তাই বলা যাবে? অশ্রাব্য, অশ্লীল, নগ্ন ভাষার চূড়ান্ত এই চলচ্চিত্রের ওটিটি প্রদর্শন কি নিজের পরিবারের সকলকে নিয়ে দেখার উপযোগী? যদি না হয়, তাহলে এটি অ্যাডাল্ট চলচ্চিত্র হিসেবে দাখিল হলো না কেন?
সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র সুশীলতায় ঘেরা আপনি ও আপনারা!
নারীকে নিয়ে একটি কথা সমাজের যে কোনো স্তর থেকে আসলে আপনাদের চিত্তে আগুন জ্বলে উঠে আর এখানে নিজের বাবা, মা, ভাই ও বোন নিয়ে দেখতে না পারার মত কনটেন্টকে শিল্পের নামে চালিয়ে দিয়ে আবার সাফাই গাচ্ছেন? নিজেদের ভণ্ডামি নিয়ে লজ্জা হয় না আপনাদের? সাম্যাবস্থা বজায় রাখা ভাল, তাই বলে পুলিশকে এতকিছু মনে রাখতে বলার কিছু নেই!
মাথায় রাখতে হবে, অতীতকাল থেকে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পুলিশের উপস্থাপন এদেশের পরিচালকেরা যেভাবে দেখিয়েছেন, সেটি হলো নায়ক সব মারপিট করে সমাধান করেছেন এবং সবশেষে পুলিশ যেয়ে বলছে, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’! এত এত খুনি, ডাকাত, দস্যু ও ধর্ষণকারী গ্রেফতার হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে দিনের পর দিন, তা নিয়ে কি একটা থিম বেইজড মুভি হয়েছে? গুটিকয়েক পরিচালকগণ ছাড়া সেটি উপস্থাপনের শক্তিই তো নেই অনেকের।
পুলিশ বলতে অমল বোসের বড় পেট, দিলদারের কান চুলকানো! ধীরে ধীরে এসবই ঢুকানো হয়েছে মাথায়। তাতে মনের আশা মেটেনি, এখন নতুন উদ্যমে মেতে উঠতে হয়েছে! এ থেকে যা শিখলাম, স্বল্প শিক্ষিত লোকজনের নারী বিদ্বেষী কথায় শুধু নারীর অপমান তথা অবমাননা হয়, শিক্ষিতদের জঘণ্য ও অশ্রাব্য উপস্থাপনে নারীর মোটেই অবমাননা হয় না!
যারা এই বিষয়কে, শিল্পের নামে প্রতিক্রিয়া দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন, তাদেরকে আমার কোনো অংশেই তথাকথিত নারী অবমাননাকারীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া মনে হচ্ছে না! এক কাজ করুন, নিজের মুখোশটুকু খুলে আসল চেহারা দেখান প্লিজ, ব্যক্তি, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে অন্যায়কে অন্যায় না বলে সকল পরিস্থিতিতে অন্যায়কে অন্যায় বলতে শিখুন।