হাইব্রিডদের কনুইয়ের ধাক্কায় ত্যাগীরা ছিটকে পড়ছে!
যেকোন নির্বাচন সামনে এলেই শুনি মাঠপর্যায়ের জরিপ, এজেন্সির রিপোর্ট এসব দেখে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। ক্লিন ইমেজ, দলের প্রতি কমিটমেন্ট এবং জনপ্রিয়তায় যে এগিয়ে থাকে মনোনয়ন তার ভাগ্যেই জোটে; এমনটাই প্রচার করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। গত কয়েক দিন ধরে বেশ কয়েকটা ফোনকল পেয়েছি। পরশু রাতে আমার স্যারের সাথে ফোনকল গুলোর ব্যাপারে আলাপ করছিলাম। আমার মতন স্যারও বেশ অবাক হলেন এবং প্রশ্ন করলেন পার্টি আসলে কারা চালায়, কাদের ইশারায় চলছে সবকিছু? ফোনকলগুলোর সারমর্ম হলো, আপনারা তো গণমাধ্যম কর্মী, আমার জেলার ডিসি এসপিকে একটু চাপে রাখেন যাতে ইলেকশন ফেয়ার হয়। আমি প্রশ্ন করি কি হবে তাহলে। তাদের উত্তর নৌকা ৩য় বা ৪র্থ হবে। আমি অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করি; এরা মনোনয়ন পেলো কি করে? তাদের উত্তর ; সব ম্যানেজ করে আপা। এলাকায় তাদের সাথে দুইটা লোকও হাঁটে না। চরম অজনপ্রিয় তারা। আমি ভাবি; ভাবতেই থাকি কিন্তু আমার ভাবনা আর শেষ হয় না। এসব রিপোর্ট টিপোর্ট যে পুরোটাই শুভংকরের ফাঁকি সেটার প্রমাণ মিলেছে গত পরশুর মনোনয়ন বোর্ডের একটা সিদ্ধান্তে।
গতকালের একটা খবরে চোখ আটকে গেলো, নরসিংদীতে নৌকা পেলেন লোকমান খুনের চার্জশিটভুক্ত আসামি! খবরে প্রকাশ নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি, যিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছিলেন, সেই খুনি আশরাফ হোসেন সরকারই পেলেন নরসিংদী পৌর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নৌকার প্রতীক। গত বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রী বাসভবন গণভবনে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় নরসিংদী পৌরসভায় মেয়র পদে আশরাফ হোসেন সরকারকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।
নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমানকে যার পরিকল্পনায় হত্যা করা হয়েছিল সেই খুনি আশরাফকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় জেলা এবং শহর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ হতবাক-ক্ষুদ্ধ। ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে আশরাফ হোসেন সরকারের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের জেলার সভাপতি-সম্পাদক।
বিতর্কিত এবং জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি আশরাফ সরকার নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় দলের ভেতরেই তীব্র অসন্তোষ শুরু হয়। গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আগের মনোনয়ন বাতিল করে আমজাদ হোসেন বাচ্চুকে দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়।
আমার প্রশ্ন হলো এতসব জরিপ, এজেন্সির রিপোর্ট পাশ কাটিয়ে কিভাবে একজন খুনী মনোনয়ন পেলো? তবে কি সব রিপোর্টই এই খুনীর পক্ষে ছিল? এই মনোনয়নের পেছনে কে বা কারা কলকাঠি নেড়েছে সবার আগে সেটা সামনে আসা উচিত।
অতিপ্রচার আর লোভ একে একে সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আগে জানতাম যারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে কাজ করে তারা প্রচার প্রচারণার আলোয় আসেন না। নীরবে নিভৃতে তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যান। পৃথিবীর কোন দেশেই সম্ভবত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমাদের এখানকার মতন কার্ড শো করে ঘুরে বেড়ান না। তাদের পদোন্নতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসেন না। আমার কোনভাবেই মাথায় আসে না; এত আত্মপ্রচারের আলোয় এরা গোয়েন্দাগিরিটা কখন করে!
আরেকটা ব্যাপার খুব বাজে লাগে আমার কাছে। একটা ইউনিয়নের কমিটি হতে গেলেও নাকি এখন গোয়েন্দা রিপোর্ট লাগে। দলের ব্যাপার দলীয় ফোরামেই সমাধান হওয়া উচিত; কোন এজেন্সির রিপোর্টে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংগঠন।
আমি খুব বিশ্বাস করি রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত। কোন প্রেসক্রিপশন; কোন ফর্মূলায় চলা উচিত না। এদেশের কৃষক, গার্মেন্ট শ্রমিক, রেমিটেন্স যোদ্ধা এরা কিন্তু কেউ চুরি করে না। ২০ কোটি মানুষের মুখের সামনে খাবার তুলে দিচ্ছেন ঐ গরীব কৃষক। বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছে গরীব গার্মেন্ট শ্রমিক। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আসছে পা ফাটা শ্রমিকের রক্তঘামে। এই ৩ শ্রেণির মানুষ শুধু দিয়েই যাচ্ছে। তবে একটা জায়গায় এরা এক; এরা আসলে সবাই গরীব। আর সেই গরীবের রক্ত পানি করা টাকায় আমরা আরাম আয়েশ করছি; বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছি। একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন। একজন প্রবাসী শ্রমিক তার আয়ের প্রতিটা পাই পয়সা দেশে পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি একজন শিক্ষিত লোক কি করছেন? দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছেন। আসল গরীব তাহলে কে?
মানুষের মনে স্বস্তি নেই। বড় বড় ইমারত, ফ্লাইওভার, ব্রিজ, কালভার্ট এসবের চেয়ে বেশি জরুরি মানুষের মধ্যে মানবিকতা আর নৈতিকতার চর্চার জায়গাটা ঠিক রাখা। আরেকটা কথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ‘৭৫ এর পরেও এতটা দুর্বল ছিল না। সরকারের সফলতার হিসেব করতে বসবো না এখন। কিন্তু দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ভাবে চরম ব্যর্থ এবং দুর্বল। কোথাও কোন সমন্বয় নেই। দলীয় কোন কর্মতৎপরতা নেই। নেতাদের সাথে কর্মীদের আকাশসমান দূরত্ব। সাংগঠনিক চর্চার জায়গাটা একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেছে। কোথাও কারো কোন সম্মান নেই। কর্মীদের ত্যাগের কোন মূল্যায়ন নেই। দালালি আর তেলবাজিটাই সব এখন। সামনে যদি কোন সংকট আসে এদের কাউকেই হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাইব্রিডদের কনুইয়ের ধাক্কায় ত্যাগীরা ছিটকে পড়ছে! এ বড় অশনিসংকেত।