করোনাজয়ের অগ্নিসাক্ষীরা
রোনা মোকাবিলায় পুরো বিশ্বই যখন গলদঘর্ম, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। তাদের বলা হচ্ছে, করোনার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা। পরিবারের আপন মানুষদের ছেড়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে দিনরাত করোনার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। শিশুসন্তানকে বাসায় রেখে হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন অনেক চিকিৎসক দম্পতি। বাসায় অসুস্থ বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে তাদের। সম্পূর্ণ জেনে-বুঝেই তারা নিজেদের অনেকটা মৃত্যুর মুখে সঁপে দিয়েছেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার তোয়াক্কা না করেই দিনরাত অসুস্থদের পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এ এমনই এক দুর্যোগময় মুহূর্ত, যখন অসুস্থের পাশে তার পরিবার বা বন্ধুরাও যেতে পারছে না। এমনকি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়ও কোনো প্রিয়জনের স্পর্শ পাচ্ছে না। এ সময়গুলোতে একমাত্র চিকিৎসাসেবীরাই সঙ্গী। এই ভয়াবহ মহামারির বিরুদ্ধে টানা যুদ্ধ করতে গিয়ে তারা অনেকেই আজ পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত এবং মানসিকভাবে বিপর্যন্ত। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। লাশের সারি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যাই করেছেন এক শীর্ষ মার্কিন চিকিৎসক, এমন গল্প খুঁজলে পাওয়া যাবে অনেক। তবু সব কষ্ট আর ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা মুখে হাসি নিয়ে বিশ্বজুড়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন অগণিত করোনা রোগীকে।
তবুও করোনা আতঙ্কে ভীত হয়ে আমাদের দেশের কিছু মানুষ ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে করেছিল অমানবিক আচরণ। ডাক্তারদের ভাড়া বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া বা বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। গোপালগঞ্জে এক নারী স্বাস্থ্যকর্মীকে পুকুরের পাশে তালপাতা দিয়ে একটা ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে সেখানে রাখা হয়। ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি চাকরি করতেন। করোনাভাইরাসের কারণে তিনি ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরে আসার পর সুরাহা হয় পরবর্তী সময়ে। নারায়ণগঞ্জে এ অবস্থা আরও ন্যক্কারজনক আকার ধারণ করেছিল। সেখানে চিকিৎসক দম্পতির বাড়িতে উপর্যুপরি ঢিল ছুড়েছে এলাকাবাসী।
এ দৃশ্য দেখা গেছে ভারতেও। সেখানে হামলার শিকার হয়েছেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কর্মরত চিকিৎসাকর্মীরা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসকদের গালাগাল শুনতে হচ্ছে এবং বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের হামলা ও অশ্নীল বাক্যবাণের শিকার হতে হচ্ছে নার্সদের। এমনকি করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করায় প্রতিবেশীরা চিকিৎসকদের একঘরে করে রাখছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরে সুরক্ষা পোশাক পরা দুই নারী চিকিৎসককে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারছে এক দল লোক। এক নারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কিনা পরীক্ষা করতে ওই দুই চিকিৎসক ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় গিয়েছিলেন।
এমনই সব অসহযোগিতা ও আক্রমণ সহ্য করেই চিকিৎসাকর্মীরা বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী এ মহামারির প্রথম আঘাতকে মোকাবিলা করেছেন। হামলায় আহত হওয়ার পরও এক চিকিৎসক বলেন, ‘এই হামলা আমাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারবে না।’
দেশজুড়ে করোনা আতঙ্কের জেরে এখন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংটাই নিয়ম। নিজেদের মধ্যে কমপক্ষে এক মিটার দূরত্ব রাখতে বলছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের তো সে উপায় নেই। যতই পিপিই কিট থাক, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে তাদের। অনেক হাসপাতাল থেকেই চিকিৎসাকর্মী, নার্স ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বারবার বলছেন, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ইচ্ছা থাকলেও তেমন উপায় নেই। কারণ যে রকম পোশাক ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাঁদের কাছে থাকার কথা, তা অনেক সময়েই দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে আঘাতের শুরুতেই। ফলে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে সেখানকার চিকিৎসাকর্মীদেরও। এর মধ্যেই চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার চিকিৎসক ও নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। গত মে মাসেই দেশটিতে প্রায় ৬২ হাজার চিকিৎসাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বছর শেষে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে কত দাঁড়িয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
ভারতেও মে-জুনের মধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৩৮২ চিকিৎসক মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী হলেন ২৭ বছরের চিকিৎসক এবং বেশি বয়সী ছিলেন ৮৫ বছরের ডাক্তার। তারা সকলেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়েই মারা গেছেন।
সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার চিকিৎসক করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল।
কর্মক্ষেত্র বা পেশার নিরিখে করোনার কবলে পড়ার ঝুঁকি কেমন? সামগ্রিক ভাবে কোন কোন পেশা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানা থাকলেও এ যাবত পেশাগত ঝুঁকির অঙ্ক জানা ছিল না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের একটি সমীক্ষায় সে সম্পর্কে ধারণা করতে পারছেন বিশেষজ্ঞরা। দেখা যাচ্ছে, অন্যদের চেয়ে চিকিৎসাকর্মীদের করোনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৮ গুণ বেশি।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ডাক্তার-নার্সদের আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ বাস্তবে অপরিমেয়। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের তুলনায় ডাক্তার ও নার্সদের করোনা টেস্ট রেজাল্ট ১২ শতাংশেরও বেশি পজিটিভ হয়েছে বিশ্বজুড়ে। ফলে চিকিৎসাসেবা যারা দিচ্ছেন তাদের মৃত্যুর হারও কম নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে সাত হাজারের বেশি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের অধিকাংশই আক্রান্ত হয়েছেন রোগীদের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে আসার ফলে। কিন্তু এ খবর আজ থেকে কয়েক মাস আগের। এই তালিকায় প্রথমেই ছিলো মেক্সিকো। দেশটিতে ডাক্তার-নার্স ও সেবাকর্মী তখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ১৪০০ জন। যুক্তরাজ্যে তখন মারা গেছেন প্রায় ১১০০ জন ডাক্তার ও নার্স। যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলে এই সংখ্যা সাতশরও বেশি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে মৃত্যুবরণ করেছেন পাঁচশর বেশি ডাক্তার ও নার্স। বাংলাদেশে ডাক্তার ও নার্সের মৃত্যুর সংখ্যাও কম ছিলো না। মৃত্যুর এই মিছিল চলমান।
গত বছরের একেবারে শেষে চীনের উহান থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতন হতে প্রথম যিনি আহ্বান জানান, তিনিও ছিলেন একজন ডাক্তার। তার নাম ডা. লি ওয়েনলিয়াং। উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ ৩০ ডিসেম্বর একটি চ্যাট গ্রুপে সহকর্মীদের সার্সের মতো নতুন এক ভাইরাসের ব্যাপারে সতর্ক বার্তা পাঠান। পরবর্তী সময়ে তাকে প্রশাসনের দ্বারা হয়রানির শিকারও হতে হয়। এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যান ওই চিকিৎসক। লি ওয়েনলিয়াংয়ের মৃত্যুতে চীনে জনরোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য চীন সরকার ভুল স্বীকার করে ডা. লিকে বীরের সম্মাননা প্রদান করে।
কলকাতার একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হোক বা না-হোক, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কভিড পজিটিভ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় একই। দু’ক্ষেত্রেই সংক্রমিত হওয়ার নজির শতকরা ১২ জনের। অন্য পেশার লোকজনের কভিড সংক্রমণ নিয়ে অবশ্য কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না এ যাবৎ। এখন জানা যাচ্ছে, ঝুঁকির এই হার অন্যদের চেয়ে পরিবহনকর্মীদের ২.৫ গুণ, পুলিশ ও সমাজকর্মীদের ২ গুণ, সেলস ও শিক্ষাকর্মীদের ১.৪ গুণ এবং অন্য জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ১.৬ গুণ বেশি। প্রায় এক লক্ষ ২০ হাজার মানুষের ওপর চালানো বিশাল সমীক্ষার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে), যাতে এভাবে পেশার নিরিখে ঝুঁকির অঙ্ক কষা হয়েছে ব্রিটেন ও আমেরিকায়।
গল্গাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সমীক্ষার ফল দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশের মতো সমাজব্যবস্থায় সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা যেহেতু কম, তাই আপেক্ষিক ঝুঁকির এই হার পেশা নির্বিশেষে আরও বেশি এখানে। একের পর এক চিকিৎসাকর্মীর মৃত্যুই এর প্রমাণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেশা নির্বিশেষে উপসর্গহীন করোনা-বাহকের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকদেরই। সে জন্যই তাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হারও সর্বাধিক। পুলিশ, পরিবহনকর্মী ও সমাজকর্মীদের মধ্যেও করোনার থাবা বেশ বড়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব ক্ষেত্রেই ঢিলেঢালা মনোভাবের কারণে পেশা নির্বিশেষে করোনা হামলা চালায়। করোনা রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা মোটামুটি একই প্রটোকল মেনে চলেন। কিন্তু অন্যান্য রোগীর চিকিৎসায় উন্নত দেশের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশের বিস্তর ফারাক। মূলত সেই ফাঁক গলেই সংক্রমিত হন চিকিৎসাকর্মীরা। করোনাহীন রোগীদের চিকিৎসায় উন্নত দেশে অনেক আঁটসাঁট করোনা-সুরক্ষা মানা হয়। সেই বিচারে আমাদের দেশে ঝুঁকিটা যুক্তরাজ্যের মতো ৮ শতাংশ হবে না, হবে ঢের বেশি।
নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষ বিস্তর মেলামেশা করতে বাধ্য হন। উপসর্গহীন করোনা-বাহকের সঙ্গে সংস্রব হচ্ছে কিনা তা আগাম বোঝার উপায় নেই। সে জন্যই চিকিৎসাকর্মীদের মতো না হলেও পুলিশ, পরিবহনকর্মী, সমাজকর্মী ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যেও ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। করোনা সংক্রমণের রাস্তাগুলো না বুঝে, না জেনে অথবা বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ করা যাচ্ছে না বলেই ছড়াচ্ছে রোগটা।
গত এপ্রিল মাসে ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু’জন কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নেওয়ার পর হাসপাতালটির স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত মানুষদের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়ে সমানভাবে।
তাছাড়া কভিড-১৯ মহামারির সময় করোনা সেবায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এ সংকট এখনও কমেনি খুব একটা। এমনকি আইসিইউ পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায়নি সময়মতো। ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকলেও চিকিৎসাকর্মীদের আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকির মাত্রাও এর অন্যতম কারণ।
বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে যেখানে খুবই সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মী পদায়নের মাধ্যমে অল্প জনসম্পদ দিয়ে বেশি মানুষের সেবা দেওয়া দরকার, সেখানে সরকারের নতুন নিয়োগ দেওয়া দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজার নার্সের অনেককেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে ঢাকার বাইরে পদায়ন করা হয়েছে। অথচ ঢাকার বাইরে কভিড-১৯ ডেডিকেটেড চিকিৎসার ব্যবস্থা খুব একটা নেই। এসব কারণেও করোনা চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে জরুরি চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়েছে। নিয়মানুযায়ী করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীরা এক সপ্তাহ ডিউটি করার পর ১৪ দিনের আইসোলেশনে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সীমিত মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়াই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
পৃথিবীময় দিন দিন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় সমন্বয়হীনতা, অবহেলা, এমনকি নিজেদের অবৈধ ব্যক্তিগত লাভের দিকে নজর দেওয়ার মতো কর্মকা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তাছাড়া আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সিন্ডিকেট যে সক্রিয়, তা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। চিকিৎসকদের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত চক্র, ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহকারী চক্র, পাস না করলেও মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া চক্র, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোর যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সক্রিয় সিন্ডিকেটসহ বহু সমস্যায় জর্জরিত স্বাস্থ্য খাত। মহামারির মতো জরুরি সময়েও নকল মাস্ক সরবরাহ, ঢাকায় পদায়ন না করে ঢাকার বাইরে চিকিৎসক ও নার্স পদায়নসহ নানা ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা।
চিকিৎসক সংকটের কারণে করোনা চিকিৎসার হাসপাতালগুলোতে নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দুই শিফটে কাজ করতে হচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এমন চাপ নিয়ে ভালো সেবা দেওয়া যে সম্ভব নয়, তা সহজেই অনুমেয়। তার ওপর এরই মধ্যে হাজার হাজার চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মী করোনায় আক্রান্ত। এরই মধ্যে অনেক চিকিৎসক ও নার্স করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে চিকিৎসক ও নার্সদের মনোবল দুর্বল হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তার ওপর যদি দুই শিফটে কাজ করতে হয়, তাহলে তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ভগ্ন হৃদয়ে আর যাই হোক ভালো সেবা যে দেয়া যায় না, তা আমাদের অজানা নয়। এ ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থে, সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। তবু এ সবকিছুর পরেও আমাদের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী যারা এতগুলো মাস ধরে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তা নিঃসন্দেহে অভিবাদনযোগ্য।
অনেক চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মী করোনা জয় করে আবারও রোগীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে করোনা আঘাতের শুরুর দিকেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ জনের বেশি চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছিলেন করোনাভাইরাসে। তারা অনেকেই সুস্থ হয়ে পরে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। এভাবেই প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে করোনাজয়ের এই অগ্নিসাক্ষীরা দীর্ঘমেয়াদে এই প্রাণঘাতী মহামারি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হচ্ছেন। অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। বহু চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী জীবনের ঝুঁকিতে আছেন। তবু মানুষের সেবায় সভ্যতার শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে তারা প্রাণপণ নিয়োজিত থাকবেন।