তুরস্কের ছেলে ‘ফাইজার’ ও ‘অ–সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন
‘একটা শিশু, এই যে ফাইজার, তুরস্কের ছেলে। মুসলিম ছেলে, করোনা ভাইরাসের একমাত্র সফল ভ্যাকসিন…আলহামদুলিল্লাহ…তুরস্কের ফাইজার নামক যে ছেলেটা, সে আবিষ্কার করেছে। কিন্তু আপনারা জানেন না, কারণ এটা প্রচার হবে না। এটা যদি কোনো খ্রিষ্টান আবিষ্কার করত তাহলে আজকে জনে জনে সবাই তার নাম জানত। সবাই শুনতেন যে খ্রিষ্টান অমুক যুবক…সে ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছে।’ এই জবরদস্ত হেকমতওয়ালা কথা যিনি বলেছেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত ধর্মীয় একজন বক্তা। তাঁর বক্তব্যের ভিডিওচিত্র ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ফাইজার নামের এই শিশু বিজ্ঞানীর বাড়ি তুরস্কের কোন শহরে, সে কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এবং তার খবর এই ভদ্রলোকের কাছে কীভাবে এল তা তিনি বলেননি। কিন্তু ‘একটা শিশু, এই যে ফাইজার, তুরস্কের ছেলে’—কথাটি তিনি যেভাবে বলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে নাবালেগ ফাইজার তাঁর আপন চাচাতো বোনের ছোট ননদের আপন ফুপাতো বোনের দেওরের আপন মামাতো ভাইয়ের শ্যালক গোছের অতি নিকটস্থানীয় কোনো কুটুম।
ওই বক্তা বলেছেন, ‘আপনারা জানেন না, কারণ এটা প্রচার হবে না’। মানে, ফাইজারের কথা প্রচার হয়নি বলে আমরা জানতে পারিনি কিন্তু তিনি জেনে বসে আছেন। আমরা জানতে পারি না, কিন্তু তিনি জানেন—এমন ঘটনার সব এই লেখায় উল্লেখ করতে গেলে পত্রিকাকে ৩২ পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা বের করতে হবে।
তবে দু একটা ‘স্যাম্পল’ পেশ করি। এর আগে ওই বক্তা বলেছেন, ‘এমন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে, যে ভ্যাকসিন মাইক্রোচিপের মাধ্যমে তারা পুশ করবে। মাইক্রোচিপটা শরীরে ঢোকালে চালের মতো ছোট্ট একটা মাইক্রোচিপ দিলে, আপনার জীবনে প্রাইভেসি বলে আর কিছুই থাকবে না। আপনি আপনার টয়লেটে যাবেন, তারা দেখবে। স্বামী স্ত্রীর সাথে থাকবেন তারা দেখবে।’
তারও আগে ভাইরাসের আবির্ভাবের কারণ হিসেবে তিনি ‘খোয়াবতত্ত্ব’ হাজির করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইতালি থেকে মামুন মারুফ নামের এক লোক তাঁকে ফোন করেছিলেন। সেই মামুন নাকি স্বপ্নে দেখেছেন, করোনাভাইরাস মামুনের সামনে এসে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় তাঁকে বলেছে, তারা (করোনাভাইরাসরা) ২৩ অক্টোবর (২০২০) চীনে এসেছে। সেখানে এক মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করার পর করোনা সোলজারদের পাঠানো হয়েছে। করোনাভাইরাস ইমাম মাহাদির আত্মপ্রকাশের কথা বলেছে। এমনকি স্টার জলসা দেখলে বাংলাদেশের নারী-পুরুষকে কীভাবে ধরবে তাও নাকি করোনাভাইরাস মামুনকে বিশদভাবে বলেছে। ওই বক্তা বলেন, ‘আপনারা জানেন না। আসলে আমার হাতে একটা স্বপ্ন গ্রুপ আছে।’
আরও এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘আগামী বিশ্বে ম্যাথমেটিক্সের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। কারণ সাইন্স থাকবে না। উড়ে যাবে। আগামী এক দশক টিকে কিনা আমার সন্দেহ।…পৃথিবী আছে সাতটা। আগামী পাঁচ বছরে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠে আসতে পারে। নাসা বিজ্ঞানীদের কথা এগুলো।’
এসব কথা দিনে দুপুরে এই ভদ্রলোক ধর্মীয় জলসায়, ফেসবুকে, টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে বলে যাচ্ছেন। অতি আশ্চর্যের বিষয় তাঁর সামনে বসা একটি লোকও উঠে দাঁড়িয়ে বলছেন না, ‘হুজুর, ফাইজার নামের কোনো তুর্কি ছেলে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেননি। বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান “ফাইজার” এর সহযোগিতায় “বায়োএনটেক” নামের একটি জার্মান বায়োটিকনোলজি কোম্পানি এটি ডেভেলপ করেছে।’
‘বায়োএনটেক’ এর সিইওর নাম উগুর সাহিন। বয়স ৫৫ বছর। সাহিন তুরস্কের বংশোদ্ভূত একজন জার্মান চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি মুসলিম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদান রাখার জন্য শুধুমাত্র মুসলিম গবেষক ও বিজ্ঞানীদের ইরান সরকার ‘মুস্তাফা প্রাইজ’ নামের যে সম্মাননা দিয়ে থাকে তিনি সেই পুরস্কার পেয়েছেন। সম্ভবত সেই তথ্য বিকৃত হয়ে ওই বক্তার কাছে গেছে এবং তিনি সজ্ঞানে-অজ্ঞানে সেই তথ্যকে বিকৃত করে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁর কথা শুনে সামনে বসে থাকা মুসল্লিদের কেউ প্রতিবাদ করছেন না, বরং তাঁর ধমকির সুরে বলা ‘কথা ঠিক কিনা?’ প্রশ্নের জবাবে ‘ঠিক, ‘ঠিক’ বলে অনুসমর্থন দিচ্ছেন। যাঁরা এই সব ভিডিওচিত্র দেখছেন তাঁদের কাছে বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের সামগ্রিক জ্ঞান ও বিচার বিবেচনাবোধ সম্পর্কে কী ধরণের নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে তা ভাবার বিষয়।
বিজ্ঞাপন
দুশ্চিন্তার কথা হলো শুধু ওই বিশেষ বক্তা নন, তাঁর মতো আরও অনেকেই এই ধরনের মিথ্যা তথ্য দিনের পর দিন দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ফুটবল খেলেছেন কিংবা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন বলে মিথ্যা দাবি করেছেন। এটি যে ইসলামের কত বড় অবমাননা, সে বিষয়ে হক্কানি আলেমদের দিক থেকেও জোরালো ভাষ্য আসছে না।
কিছু মিথ্যা ধরা কঠিন। কিছু মিথ্যা বোঝা পানির মতো সোজা। ফাইজার নামের ছেলে ভ্যাকসিন বানিয়েছে—এই কথার মধ্যে অসত্য যে শতভাগ তা বুঝতে বিরাট জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যখন একজন স্বীকৃত আলেম সুন্নাতি পোশাকে, সুন্নাতি চেহারায় মসজিদের মধ্যে বসে এই কথা বলেন, তখন ইমানদার মুসল্লিদের পক্ষে তা মিথ্যা ভাবা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এই মিথ্যা ধরিয়ে দিলেও শুধু আলেমদের প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাসের কারণে সেই মুসল্লিদের বিরাট একটি অংশ অসত্যবাদী বক্তার পাশে দাঁড়ান। যুক্তি বা সত্য তখন অন্ধবিশ্বাসের রোষে পড়ে কোণঠাসা হয়ে যায়।
বিশ্ব জুড়ে ‘পোস্ট-ট্রুথ’ রাজনীতির যে বাড়বাড়ন্ত, চারদিকে ‘অ-সত্যাগ্রহী’ নেতাদের যে অতিস্পর্ধিত লাফালাফি, এই ‘আলেমরা’ তার সুযোগ নিচ্ছেন। তাঁরা এমন কিছু অনুসারী গড়ে তুলছেন যাঁরা সত্য-মিথ্যা বিবেচনার চেয়ে ‘নিজের মতো নেতা’ পাওয়ার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেন। আর এই ‘নিজের মতো’ ভাবনাটির মধ্যে বরাবরই সত্যতার ভাগ থাকে অতি অল্প।
যেহেতু বিনোদন বিনা জগৎ মিথ্যা, যেহেতু তামাশার অনুশীলনই গণতন্ত্র, সেহেতু এই সব বক্তব্য ফেসবুকে নির্ভেজাল তামাশার বিনোদন হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। মিলিয়ন মিলিয়ন ‘ভিউ’, ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ দেখা যাচ্ছে। তাতে সেই বক্তাদের ‘মার্কেট’ বাড়ছেই। এর চেয়ে বড় ধর্মাবমাননা আর কী হতে পারে?