অসম নীতিমালা: প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় শিল্প

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ক্রয়জনিত অসম নীতিমালার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠাগুলো। এতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে দেশের সার্বিক উন্নয়ন।

এসব উদ্যোক্তা দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। সাশ্রয় করেছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু নীতির অসামঞ্জস্যতার কারণে বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশীয় পণ্য।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আইনের ফাঁক গলিয়ে অবাধে আমদানি করছে নিম্নমানের ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রনিকস পণ্য। একদিকে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ড ও দেশের নাম উল্লেখ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্র আহ্বান করছে, অন্যদিকে মান যাচাই না করে বা বিএসটিআই সনদ ছাড়াই বিদেশি পণ্য আমদানি করা হচ্ছে দেদার। আর বিএসটিআই সনদের বাধ্যবাধকতা না থাকায় নিম্নমানের বিদেশি পণ্যে দেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে।


সংশ্লিষ্টরা জানান, অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানি খাতে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে সরকার দেশীয় শিল্প খাতে নানান সুবিধা দিচ্ছে।  এসব সুবিধার কারণে বেসরকারি খাত এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্পাদিত পণ্য রপ্তানিও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। 


তবে সরকার একদিকে সুবিধা দিলেও ক্রয়নীতির কিছুটা পরিবর্তন না করায় বিদেশি পণ্য দেশে ঢুকছে দেদার। আবার কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই বিদেশি পণ্য প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখায় দেশীয় পণ্য পিছিয়ে পড়ছে, যা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের জন্যও হুমকিস্বরূপ। অথচ বিপুল জনসম্পদের এই দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদার জোগান দেওয়ার সুযোগ যদি দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ পায়, তাহলে মানসম্মত পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে উত্পাদন করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করে আরও ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশি পণ্য এখন আন্তর্জাতিক মানসম্মত বলেই রপ্তানি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- দেশে উৎপাদিত এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর-ফ্রিজার, কম্প্রেসার, টেলিভিশন, ফ্যান, ইলেকট্রিক্যাল সুইচ-সকেট, এলইডি লাইট-বাল্ব, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ-ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং ইলেকট্রিক্যাল, হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স, প্যাসেঞ্জার লিফ্ট, কার্গো লিফ্ট দেশের বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও সুনামের সঙ্গে রপ্তানি হচ্ছে।  এসব পণ্য আন্তর্জাতিক মানসম্মতই শুধু নয়, দামে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। এসব পণ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু দেশীয় এসব পণ্যকে বি গ্রেডভুক্ত বিবেচনা করছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেশীয় ব্র্যান্ড বা উত্পাদনকারীরা তালিকাভুক্ত হতে সক্ষম হলেও কার্যত তারা দরপত্রের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 


সরকারের শিল্পনীতিতে ‘আমদানি বিকল্প স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন’-এর কথা বলা হলেও বিভিন্ন সংস্থার বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী অধিকাংশ দরপত্রে দেশীয় ব্র্যান্ড বা দেশীয় উত্পাদনকারীর অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত। সরকারি ক্রয়নীতিতে বেসরকারি স্থানীয় শিল্পের উত্পাদিত মানসম্পন্ন সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।


সূত্রমতে, প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি দরপত্রে বেশি দামের আমদানি করা পণ্যের ব্র্যান্ড বা দেশের নাম সরাসরি উল্লেখ থাকায় দেশীয় ব্র্যান্ড বা উত্পাদনকারীরা কম মূল্য প্রস্তাব করে দরপত্রে সমমানের বদৌলতে অংশ নিলেও কৌশলে বাদ পড়ে যায়। এতে সুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দেশীয় উত্পাদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে বিদ্যমান পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ২৯(৩)-এর সরাসরি ব্যত্যয় ঘটছে। যেখানে বলা রয়েছে ‘কারিগরি বিনির্দেশে কোনো পণ্যের ট্রেডমার্ক বা পণ্যের ব্যাবসায়িক নাম পেটেন্ট, নকশা বা ধরন, নির্দিষ্ট উত্স দেশের নাম, উত্পাদনকারী বা সেবা সরবরাহকারীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না।’ এবং উপবিধি (৪)-এ নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্যের বিবরণ উল্লেখ করার সুযোগ থাকলেও ব্র্যান্ড ও কোনো দেশের নাম উল্লেখ করার সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে।
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *