খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আকস্মিকভাবে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বয়স বিবেচনায় ও মানবিক কারণে সাজা ছয় মাস স্থগিত রেখে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মুক্তির শর্ত হলো, এ সময়ের মধ্যে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য তুলে ধরে আরও জানান, খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম এবং বোনের স্বামী রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই বিষয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেখানে খালেদা জিয়ার মুক্তির আবেদনের ব্যাপারে কথা বলেন তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ বা কাল খালেদা জিয়া মুক্তি পেতে পারেন বলে জানা গেছে।
করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব যখন অবরুদ্ধ, ঠিক তখনই ২৫ মাস সাজা ভোগের পর মুক্তি পেতে যাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দলীয় নেত্রীর মুক্তির খবরেও রাজপথে আনন্দ-উল্লাস করেননি বিএনপি নেতাকর্মীরা। মুক্তির সিদ্ধান্তের পর স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসী স্বস্তিবোধ করছেন।
করোনাভাইরাসে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সেজন্য ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে এখনই মুক্তির দাবি জানান বিএনপি নেতারা।
সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে আজ বুধবারের মধ্যে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহীদুজ্জামান। তিনি সমকালকে বলেন, আশা করি বুধবারের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া শেষ করা যাবে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তির বিষয়টি কারারক্ষীদের মাধ্যমে গতকালই খালেদা জিয়াকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদ নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দি আছেন খালেদা জিয়া। পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হলেও গত বছর ১ এপ্রিল থেকে কারা তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া।
সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে ঢাকার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া এবং ওই সময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না- এমন শর্তে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মতামত পাঠিয়েছি।’ তিনি বলেন, তার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সদয় হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই তিনি মুক্তি পাবেন। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউকে বিদেশে পাঠানো মানে তাকে সুইসাইডের মুখে ফেলা।
অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আরও বলেন, খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমার কাছে একটা দরখাস্ত করা হয়েছিল। আবেদনে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার কথা উল্লেখ করা হয়। এরপর খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, তার বোন সেলিমা ইসলাম, তার বোনের স্বামী রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই বিষয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেখানে এই আবেদনের ব্যাপারে তারা কথা বলেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
চিকিৎসার শর্তের বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, এখানে কিন্তু বলা হচ্ছে না যে, তিনি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। হাসপাতালে যদি ভর্তি হতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে মানসম্পন্ন হাসপাতালেই তো তিনি আছেন। হাসপাতালে তাকে ভর্তি হতে হবে কিনা সেটা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যাবে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, ঢাকায় নিজ বাসায় থেকে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। ওই সময়ে দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর মুক্তি নির্দেশনা কারাগারে পৌঁছাবে :খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের মুক্তি দিতে আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। অনুমোদনের পর খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করা সংক্রান্ত নির্দেশনা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। এরপর খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পাবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সমকালকে বলেন, ‘আইনমন্ত্রী যা বলেছেন তা সঠিক। ইতোমধ্যে ফাইলটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছে। এটির সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। এরপর অনুমোদন হলে কারাগারে পাঠানো হবে। তবে ফাইলটি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
প্রস্তুত ফিরোজা ভবন :খালেদা জিয়ার জন্য গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ি ফিরোজা ভবন প্রস্তুত করা হয়েছে। মুক্তির পর তিনি এ বাড়িতেই উঠবেন বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পর তার ভাই শামীম ইস্কান্দার সমকালকে বলেন, খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর তার বাসভবন ফিরোজায় উঠবেন। বাড়িটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে।
বিএসএমএমইউর সামনে নেতাকর্মীর সমাগম :খালেদা জিয়ার মুক্তির সংবাদের পরপরই গতকাল রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সামনে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী ভিড় করতে থাকেন। এর মধ্যে দলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, আন্তর্জাতিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালের সামনে নেতাকর্মীদের ভিড় না করতে দলের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তারা সরে যান।
দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা :জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজার রায় ঘোষণার পর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর দুদকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাজা দশ বছর বৃদ্ধি করেন হাইকোর্ট।
অন্যদিকে, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে একই বছর ঢাকার আদালত সাত বছরের কারাদ দেন। এরপর তিনি সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে জামিন চান। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার করা আপিল গত বছর ৩১ জুলাই খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন তার আইনজীবীরা। এরপর গত বছর ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ উভয়পক্ষের শুনানি শেষে পর্যবেক্ষণসহ জামিন নাকচ করে আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেন।
পরে জামিন চেয়ে ফের আবেদন করা হলে সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট কারাবন্দি খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন আবারও খারিজ করে দেন। জামিনের পক্ষে ‘নতুন কোনো কারণ না পাওয়ায়’ জামিন দেননি বলে জানিয়েছেন আদালত। উচ্চ আদালতে কয়েক দফা চেষ্টা করে বিফলের পর গত ৪ মার্চ খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য সাময়িক কারামুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। আবেদনপত্র পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চিঠির আইনগত বিষয়টি পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয় তার মুক্তির বিষয়ে মতামত দেয়।