সুদের হার বাড়াল যুক্তরাষ্ট্র, আরো শক্তিশালী হচ্ছে ডলার

আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে দেশে বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। একদিকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর সুদের হার বৃদ্ধির ফলে ডলার দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে। যদিও দেশের বাজারে রেকর্ড দামের পর গতকাল বুধবার দাম কিছুটা কমেছে।

গতকাল দেশে খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১০৮.৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, গত মঙ্গলবার যে দাম ১১২ টাকা ছাড়িয়েছিল।

খোলাবাজারের পাশাপাশি আন্ত ব্যাংক লেনদেনেও ডলারের দর বাড়তির দিকে। গতকাল আন্ত ব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। গত বছরের ২৬ জুলাই প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।

নগদে ডলার কেনাবেচায় জড়িত একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত কয়েক সপ্তাহে দেশে খোলাবাজারে দ্রুত ডলারের দাম বেড়েছে। গত ঈদুল আজহার আগেও বাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার কিনে থাকি। বিদেশগামী যাত্রীদের জন্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমরা প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে পারছি না। ’

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ গতকাল আরেক দফা সুদের হার বাড়িয়েছে। এদিন ফেড ০.৭৫ শতাংশ সুদের হার বাড়ায়। এতে দেশটির নীতি সুদের হার বেড়ে দাঁড়ায় ২.৪ শতাংশ, যা ডলারকে আরো শক্তিশালী করবে। অথচ চার মাস আগেও দেশটির সুদের হার ছিল শূন্য শতাংশ। এদিকে প্রতি মাসেই ফেড কয়েক বিলিয়ন ডলার করে বন্ড কিনছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রাবাজারকে আরো অস্থির করে তুলছে।

অভ্যন্তরীণ প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্ত ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল; কিন্তু এর পর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলারসংকট শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত আছে। ২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্ত ব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। তবে গত বছরের ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৮৫ টাকা ছাড়ায়।

এ অবস্থায় টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে প্রতিদিনই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মঙ্গলবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। ২৬ জুলাই পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে ৯৯ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস শেষ হওয়ার আগেই প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হলেও বাজার স্থিতিশীল হয়নি। উল্টো দিন যত যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততটাই প্রকট হয়ে উঠছে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা সব কটি হাতিয়ারই ব্যবহার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিলাসপণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্য পণ্য আমদানি ঋণপত্রের মার্জিনও বাড়ানো হয়েছে। ৫০ লাখ ডলারের বেশি পণ্য আমদানির এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে অপ্রয়োজনীয় কিছু এলসি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের (২০২১-২২) মে পর্যন্ত ১১ মাসেই দেশের আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে ৮১.৪৯ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি ব্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের সব কটি সূচকে। দিন যত যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো ততই নাজুক হয়ে উঠছে। ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যদিও ডলারের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি।

সুদহার বাড়ানোয় ডলার ঊর্ধ্বমুখী : দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। এই বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াচ্ছে। বিশ্বের প্রায় সব বড় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত কয়েক মাসে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু উন্নত দেশে নীতি সুদহার বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার বৃদ্ধির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর ফলে সে দেশে ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীরা আর টালমাটাল সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। তারা ভাবছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করাই ভালো, বাড়তি সুদ পাওয়া যাবে। আর তারা ভারতের মতো বৃহৎ দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বিশ্বজুড়েই ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ছে, দেশে দেশে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হচ্ছে। বিনিময়মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয়বহুল হচ্ছে, পরিণামে অবধারিতভাবে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।