ইউক্রেন নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী
জিগস’ ধাঁধাঁর সমাধান করতে বসে যদি তার খণ্ডাংশগুলোর অর্ধেক খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে সবগুলো টুকরো জোড়া দিয়ে পুরো ছবিটা চোখের সামনে আনা আসলেই অসম্ভব।ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার রাজনীতি অনেকটা এরকমই সমাধান-অযোগ্য ধাঁধাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ রুশ নকশার অনেকগুলো টুকরোরই হদিশ মিলছে না।ভ্লাদিমির পুতিন কী ভাবছেন, কী পরিকল্পনা করছেন তা বিরাট এক রহস্য এবং ক্রেমলিন চাইছে এটা রহস্যই থাকুক – এনিয়ে জল্পনাই চলুক। কিন্তু কেন? যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছে সবাই, সেগুলো হল মস্কো কি পুরো মাত্রার হামলা চালাতে চাইছে? নাকি সীমিত পরিসরের অভিযান? নাকি এটা রাশিয়ার শুধুই হুমকিধামকি – তার দাবি আদায়ের জন্য বিপজ্জনক জেনেও শেষ চেষ্টা হিসাবে চরম পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়ে ভয় দেখানো বা চাপ সৃষ্টি করার কূটনীতি?
ভূ-রাজনৈতিক ছবির এ জিগস’টা অসম্পূর্ণ। এ ধাঁধাঁ সমাধানের জন্য যে খণ্ডচিত্রগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোই পশ্চিমা দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সেগুলো হলো :
১. ইউক্রেন সীমান্তে এক লক্ষ রুশ সৈন্যের সমাবেশ।
২. স্থলে ও সাগরে চালানো মস্কোর একের পর এক সামরিক মহড়া।
৩. বেলারুশ ও রাশিয়ার আসন্ন সামরিক অনুশীলন।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ক্রেমলিনের অসম্ভব সব দাবি পেশ। যার ব্যাপারে রাশিয়া নিশ্চিতভাবেই জানতো যে যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করবে।
৫. প্রেসিডেন্ট পুতিনের মন্তব্য – রুশ ও ইউক্রেনিয়ানরা ‘একই মানুষ – অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বা।’
মস্কো নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে যে দাবি জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এখন তার জবাব দিয়েছে। ক্রেমলিন বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর বিশ্লেষণ করে দেখবে।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে: রাশিয়া
তবে ইতোমধ্যে, কড়া কড়া কথা কিন্তু থেমে নেই।এ বিষয়ে রাশিয়ার এমপি ইয়েভগেনি পোপোভ বলেন, ‘ইউক্রেন ভূখণ্ডে ন্যাটোর কাঠামো বসাবেন না। ন্যাটো জোটে আমাদের ‘অংশীদার’ দেশগুলোকে বলছি, ইউক্রেন থেকে দূরে থাকুন। আমাদের সীমান্ত থেকে সরে যান। এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা দেশগুলো থেকে বেরিয়ে যান, কারণ এটা রুশ নাগরিকদের জন্য হুমকি তৈরি করছে।’
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভিতে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন পোপোভ। তিনি ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া দলের একজন এমপি।”সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে,” বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি।আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘নাহলে কী হবে?’ এরপর ইয়েভগেনি পোপোভ বলেন, ‘নাহলে, গোটা বিশ্বের জন্য একটা গুরুতর বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কোনো কোনো পশ্চিমা কর্মকর্তা বলছেন রাশিয়ার অত সাহস নেই। ভাই – সাহসটা কি আপনারা আসলেই দেখতে চান?’
ন্যাটো কি আসলেই রাশিয়ার জন্য হুমকি?
রুশ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যেই জোরেশোরে বলছেন যে ন্যাটো রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে রাশিয়া ন্যাটোকে আসলেই যে একটা হুমকি হিসেবে দেখে তা বিশ্বাস করা কঠিন। রাশিয়ার মাত্র ছয় শতাংশ ভূখণ্ড ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর সীমানা সংলগ্ন। নেটোর সদস্য দেশগুলো, যেমন ইতালি ও হাঙ্গেরির সাথে ক্রেমলিনের সম্পর্কও ভাল। এমনকি রাশিয়া ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কের কাছে অস্ত্রও বিক্রি করেছে। আরো মনে রাখতে হবে, ন্যাটোর সদস্য দেশ নরওয়ে রাশিয়ার সীমান্তে আছে ৭০ বছরেরও বেশি সময়। এছাড়াও, ইউক্রেন, জর্জিয়া বা অন্যান্য সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো অদূর ভবিষ্যতে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, এমন কোনো ইঙ্গিতই কিন্তু নেই।
রাশিয়ার লক্ষ্য কী?
তাহলে ন্যাটো জোটকে নিয়ে ক্রেমলিনের এত মাথাব্যথা কেন? এর কারণ অংশত অভ্যন্তরীণ। কারণ রাশিয়া চায় তাদের বহিঃশত্রু বলে যাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ – তাদের বিরুদ্ধে দেশের জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু এর বাইরেও রাশিয়া এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোকে নিজের কব্জায় রাখার অনুকূল একটা ব্যবস্থা সম্ভবত গড়ে তুলতে আগ্রহী। রাশিয়া ইউরোপে তার একটা প্রভাব-বলয় আবার প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং শীতল যুদ্ধের পরিণতিকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে চায়।
প্রেসিডেন্ট পুতিন বিশ্বাস করেন, ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার দুর্বলতাগুলোর সুযোগ নিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়ার প্রতি ন্যায্য আচরণ করা হয়নি এবং রাশিয়া তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি এটা বদলাতে চান বলে মন্তব্য করেছেন আন্দ্রেই কর্তুনভ। রুশ কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের মহাপরিচালক হিসেবে আছেন আন্দ্রেই কর্তুনভ।
পুতিনের যুক্তি খুবই সোজাসাপটা। ক্ষমতার ভারসাম্য এখন বদলে গেছে। পৃথিবী এখন পশ্চিমাকেন্দ্রিক একক-শক্তির মুখাপেক্ষী নয়। আমাদের কথাও তোমাদের শুনতে হবে এবং আমাদের কোনো উদ্বেগ থাকলে তাকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।
মস্কোর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
সঠিকভাবে বলা কঠিন, কারণ জিগস’ ধাঁধাঁর সবগুলো টুকরো হাতে নেই। আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। ইউরোপীয় নিরাপত্তার কিছু কিছু দিক নিয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসার যে প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, ভ্লাদিমির পুতিন সেটাকে যথেষ্ট মনে করছেন কিনা, রাশিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্ভবত তার ওপর নির্ভর করবে। পুতিন যদি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব যথেষ্ট নয়, তিনি যদি ইউরোপের বর্তমান নিরাপত্তা কাঠামোকে ভেঙে ফেলে তা নতুন করে সাজাতে বদ্ধপরিকর হন, তাহলে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেটা হলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী টানাপোড়েন অবশ্যম্ভাবী।
কর্তুনভ বলেন, ‘আমি আশা করব, এ পর্যন্ত রাশিয়াকে যেটা প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে পুতিন সন্তুষ্ট হবেন। আমি মনে করি, তিনি কিছুটা সফল হয়েছেন। তিনি অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোকে সংলাপে বাধ্য করেছেন। তিনি যুক্তি দেখাতে পারেন যে তার মিশন সফল। ইউক্রেন সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে তিনি পশ্চিমের দেশগুলোকে রাশিয়ার প্রস্তাব অন্তত বিবেচনা করতে উৎসাহিত করতে পেরেছেন। কিন্তু পুতিন বিষয়টাকে সেভাবে নাও দেখতে পারেন। তার ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। তিনি হয়ত বলতে পারেন, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে নিরর্থক ও অব্যাহত, মীমাংসাহীন একটা আলোচনায় জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আর এরই মধ্যে ইউক্রেনে পশ্চিমা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রাখতে চাইছে।
তিনি বলেন, ‘দেশের ভেতর, রুশ সমাজ তাদের দোরগোড়ায় বড় ধরনের যুদ্ধ বাধুক তা চায় না। ইউক্রেনে বড়ধরনের সামরিক তৎপরতায় অংশ নিতে রুশরা আগ্রহী নয়।’
সূত্র : বিবিসি ও নয়া দিগন্ত