সাঈদ খোকনের ‘ঘুস কেলেঙ্কারি’ তদন্তে পিবিআই
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের শতকোটি টাকার ‘ঘুস কেলেঙ্কারি’ ফাঁস হয়েছে। তিনটি মার্কেটে অবৈধ দোকান নির্মাণের সুযোগ, বিদেশ ভ্রমণসহ নানা অজুহাতে ঠিকাদারের কাছ থেকে তিনি এ ঘুস নেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
১০০ কোটির মধ্যে কমপক্ষে ৩৫ কোটি টাকা নিয়েছেন ব্যাংকিং চ্যানেলে। তার ঘনিষ্ঠ লোকদের ব্যাংক হিসাব এবং বিশ্বস্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে এ টাকা লেনদেন হয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে টাকা যাবে তাও তিনি নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনেক সময় অবৈধ লেনদেনের মধ্যস্থতা করেন সংস্থাটির এক কর্মকর্তা। এভাবে কোটি কোটি টাকার চেক পে-অর্ডারে রূপান্তরের মাধ্যমে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে স্থানান্তর করা হয়েছে।
টাকা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সুবিধা না পেয়ে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন। যুগান্তরের হাতে আসা দালিলিক প্রমাণপত্র ধরে অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে এ ঘুস দেন বলে দাবি করেন। কিন্তু তিনি কেন এত টাকা ঘুস দিয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এভাবে দেওয়া অর্থের বিনিময়ে করপোরেশনের তিনটি মার্কেটে অবৈধভাবে ৯১১টি দোকান তৈরি করেছিলেন দেলোয়ার হোসেন ও তার সহযোগীরা। সেই দোকান ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দিয়ে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা পকেটে তোলেন-এমন অভিযোগ আছে দেলোয়ারের বিরুদ্ধেও।
ক্ষতিগ্রস্তরা দাবি করেন-ঘুস নিলেও দোকানগুলোর শেষ পর্যন্ত বৈধতা দিয়ে যাননি সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। ঠিকাদার দেলোয়ার স্বীকার করেন তিনি নিজেই ব্যবসায়ীদের পক্ষে সাবেক মেয়রের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়টি সম্পন্ন করেন।
এদিকে নতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরই অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেন ফজলে নূর তাপস। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে পড়েন দেলোয়ার হোসেন। তিনি বাধ্য হয়ে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। এরপরই মূলত ফাঁস হয় ঘটনাটি।
দেলোয়ার হোসেন যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, ‘সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে আমি ১০০ কোটি টাকার বেশি দিয়েছি। তিনি ২০ লাখ থেকে শুরু করে এককালীন ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। মার্কেটে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতেন। টাকা নিলেও তিনি ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুই করেননি। এ কারণে আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমার কাছ থেকে নগদে এবং চেকের মাধ্যমে টাকার পাশাপাশি নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বিমান টিকিট ও সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে সেন্ডস নামের সেভেন স্টার হোটেলে রুম বুকিং করে দেওয়ার বায়না ধরতেন। সেগুলোর পেছনেও অনেক টাকা গেছে। আমার প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজের বিল ছাড় করাতেও মেয়রকে কোটি কোটি টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। ১৩ কোটি টাকার বিল ছাড় করাতে তাকে ৪ কোটি টাকা দেওয়ারও নজির আছে।’
মার্কেটে অবৈধ দোকান নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মার্কেট সিটি করপোরেশনের। সেখানে দোকান নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার আমার নেই। আমি ঠিকাদার হিসাবে দোকান নির্মাণ করে বুঝিয়ে দিয়েছি। সেগুলো করপোরেশন বিক্রি করেছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলাকালে সাংবাদিক হিসাবে আপনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারেন না। আর এটা সাবজুডিস ম্যাটার বলে আমিও কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
সাঈদ খোকনের এ বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেন, ‘যে কোনো ঘটনার তদন্ত চলাকালে সাংবাদিক অবশ্যই অনুসন্ধান করতে পারবেন। তবে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে রিপোর্ট করাটা কাম্য নয়। রিপোর্টে অভিযোগ, অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের বক্তব্য তুলে ধরা যাবে। সাংবাদিকের অনুসন্ধানে স্বতন্ত্র কোনো তথ্য উদ্ঘাটিত হলে তা অবশ্যই তুলে ধরা যাবে। তবে কে দোষী, কে নির্দোষ-এ ধরনের উপসংহার উপস্থাপন করা যাবে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত নগর প্লাজা, সিটি সুপার মার্কেট ও জাকির সুপার মার্কেট। মার্কেট তিনটির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পর্যায়ক্রমে নির্মাণ শেষে ব্যবসায়ীদের কাছে এ দোকানগুলো বিক্রি করা হয়।
সিটি করপোরেশনের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন হৃদী কনস্ট্রাকশন মার্কেট নির্মাণের কাজ করে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেন, তিনটি মার্কেটই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন ঠিকাদার দেলোয়ার।
এর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিও হন তিনি। ধীরে ধীরে এগুলো অবৈধ বাণিজ্যের খনিতে পরিণত হয়। নির্মাণাধীন দোকান দিনের পর দিন সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে না দিয়ে গোডাউন হিসাবে ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে তারা জানান।
বিদ্যুৎ বিলের নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায়, অবৈধ দোকান বানিয়ে বিক্রিসহ নানা বাণিজ্য পোক্ত করতে তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের আরও ঘনিষ্ঠ হন দেলোয়ার। দফায় দফায় কোটি কোটি টাকা তার ও তার মধ্যস্থতাকারীর হাতে তুলে দেন।
আর এই ঘুস লেনদেনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘুসের টাকা ও চেক তার হাত হয়েই সাঈদ খোকনের কাছে পৌঁছেছে বলে জানান দেলোয়ার।
ফজলে নূর তাপস মেয়র হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার দুদিন পরই যে কজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, ইউসুফ আলী সরদার তাদের মধ্যে অন্যতম। তার দুর্নীতির বিষয় অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ইউসুফ আলীর স্ত্রী রাশিদা আক্তার (পাসপোর্ট নম্বর বিকে-০৪৬৪৩৩৩) ও মেয়ে ইশরাত ইয়াসমিন ইরা (পাসপোর্ট নম্বর বিকে-০৪৬৪৯৬০) কানাডা প্রবাসী। সেখানে তিনি বিপুল টাকা পাচার করেছেন বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট কানাডা যাওয়ার সময় ইউসুফ আলী (পাসপোর্ট নম্বর ওসি-৯০০৭৭৩২) বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে।
কানাডা যাওয়ার বিমান টিকিটও তিনি উপঢৌকন হিসাবে নিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেনের অমিত ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর নামের প্রতিষ্ঠান থেকে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে রোববার বিকালে ইউসুফ আলী সরদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। একই নম্বরে খুদেবার্তায় বিষয় জানিয়ে বক্তব্য চাইলেও কোনো জবাব দেননি।
এর আগে তার শান্তিনগরের বাসার সামনে গিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
চেকের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক্সিম ব্যাংক পল্টন শাখায় দেলোয়ার হোসেন নামের হিসাব নম্বর (০৪৫১৩১০০০২৮০৬৫) থেকে ১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখার মেসার্স শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামের হিসাব নম্বরে (০০৪৭০৩০০১৫৮)।
নগদ জমা দেওয়া হয় ৭৫ লাখ টাকা। চেকের মাধ্যমে জমা হয় ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেনের দেওয়া তিনটি ক্যাশ চেকে (চেক নম্বর ৫৮৪৫০৮১, ৫৮৪৫০৮২, ৫৮৪৫০৮৩) ৩ কোটি টাকা নেন সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠ ভুট্টো।
এই টাকা দেলোয়ার হোসেনের এক্সিম ব্যাংক পল্টন শাখার হিসাব নম্বর থেকে ইউনাইটেড সুগার মিলস নামের হিসাবে স্থানান্তর করে নেওয়া হয়।
এর আগে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দেলোয়ার হোসেনের হিসাব নম্বরের ১ কোটি টাকার আরেকটি ক্যাশ চেকের বিপরীতে (চেক নম্বর ৪০১৮৫৮২) তানভীর অয়েল মিলস লিমিটেড বরাবর পে-অর্ডার (নম্বর-টি ২৪১৫৭৯৪০২) ইস্যু করা হয়।
দেলোয়ার হোসেনের ইস্যু করা ২ কোটি টাকার দুটি ক্যাশ চেকের (নম্বর ৫৮৪৫০৮৭, ৫৮৪৫০৯৫) বিপরীতে লোক মারফত নগদ ২ কোটি টাকা নিলেও ইস্যু করা চেক দুটি সাঈদ খোকন ফেরত দেননি বলে অভিযোগ আছে।
এছাড়াও সাঈদ খোকন বিভিন্ন সময় বাল্যবন্ধু ভুট্টো, পরিমল ও অতুলের মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংক পল্টন শাখা থেকে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করে নেন।
এভাবে ২০১৫ সালের ২১ জুন থেকে ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লোক মারফত চার দফা নগদ ও ৪২টি চেকের মাধ্যমে ৩৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৭৫ টাকা তুলে নেয়া হয় বলে ব্যাংক রিপোর্টে উল্লেখ আছে, যা বিভিন্ন বেনামি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়।
এ হিসাবগুলো সাবেক মেয়রের ঘনিষ্ঠ লোকদের বলে সন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। টাকা লেনদেনের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, উত্তরা ব্যাংকের হৃদি কনস্ট্রাকশন সাপ্লায়ার্স, যমুনা ব্যাংকের মেসার্স হৃদি কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স, এক্সিম ব্যাংকের দেলোয়ার হোসেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের হৃদি কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স নামের হিসাব নম্বরের চেকে প্রাপকের জায়গায় ‘ক্যাশ’ ও ‘ইয়োর সেলফ’ লিখে ইস্যু করা হয়।
চেকগুলোর টাকা ইউনাইটেড সুগার মিলস লিমিটেড, তানভীর অয়েল মিলস লিমিটেড, শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজসহ আরও দুটি কোম্পানির হিসাব নম্বরে স্থানান্তর হয়।
কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেলোয়ার হোসেন ও তার মালিকানাধীন হৃদি কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্সের কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত সম্পর্ক নেই। দেলোয়ার হোসেন মূলত সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার।
তার প্রতিষ্ঠান হৃদি কনস্ট্রাকশন নগর প্লাজা, সিটি সুপার মার্কেট, জাকির সুপার মার্কেটসহ সিটি করপোরেশনের মার্কেটের নির্মাণকাজ করে।
দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে নিজের ঘুসের কারবার আড়াল করতেই উল্লিখিত কোম্পানিগুলোকে সাঈদ খোকন ব্যবহার করেছেন বলে জানান এই ঠিকাদার।
যুগান্তরের অসুসন্ধানে জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখার মেসার্স শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামের যে হিসাব নম্বরে ১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ আলী ভুট্টো।
তার ছেলে শাহনেয়াজ আলীর নামেই রাখা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম। তিনি তেল ও চিনির একজন বড় পাইকারি ব্যবসায়ী। তার অফিস মৌলভীবাজারের গুলবদন সুপার মার্কেটের নিচ তলায়।
রোববার দুপুরে সরেজমিন তার অফিসে গিয়ে দেখা যায়, ৫-৭ জন লোক কাজ করছেন। মোহাম্মদ আলী ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করে এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিতেই সবাই মুখে কুলুপ আঁটেন।
একপর্যায়ে তার ছেলে শাহনেয়াজ আলী জানালেন, তার বাবা মোহাম্মদ আলী ভুট্টো অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসাধীন। তাদের ব্যবসা, শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজে ঘুসের অর্থ লেনদেন ও সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে সম্পর্ক কী, তা জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি শাহনেয়াজ।
তবে ভুট্টোর ভাই পরিচয়ে একজন বলেন, ‘শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামের হিসাব নম্বরে এ ধরনের অর্থ লেনদেন হওয়ার কথা তাদের জানা নেই। জ্ঞাতসারে এ ধরনের কিছু হওয়ার সুযোগ নেই।’ তিনি তার নাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে আশপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোহাম্মদ আলী ভুট্টো মৌলভীবাজারে এক নামে পরিচিত। তিনি সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠ লোক বলে সবাই চেনেন। পৈতৃকভাবেই তিনি তেল ও চিনির বড় পাইকারি ব্যবসায়ী।
ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, তার মাধ্যমেই ঘুসের কোটি কোটি টাকার চেক বিভিন্ন তেল কোম্পানি ও সুগার মিলের নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়েছে।
দেলোয়ার হোসেনের প্রতিষ্ঠান অমিত গ্রুপের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, ‘শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজের মালিক ভুট্টো সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বাল্যবন্ধু। তিনি নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা নিয়ে মেয়রকে দিয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ভুট্টো, পরিমল ও অতুল সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠ লোক পরিচয়ে নগদ টাকা ও কোটি কোটি টাকার চেক নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে সেই টাকা স্থানান্তর করেছেন।’
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা সবচেয়ে প্রকটতম ও নির্লজ্জ দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলেই তিনি এটা করতে পেরেছেন। একজন জনপ্রতিধির কাছে এটা মোটেও কাম্য নয়। দ্রুত তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন। মোহাম্মদ সাঈদ খোকনসহ ৭ জনকে আসামি করে করা মামলার এজাহারে ‘ঘুস’ লেনদেনের বিষয়টি উল্লেখ আছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, বাদীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ১নং আসামি সাঈদ খোকন তার মনোনীত মেসার্স শাহনেয়াজ এন্টারপ্রাইজের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ইমামগঞ্জ শাখার হিসাব নম্বর (০০৪৭০৩০০১৫৮) নিজ হাতে লিখে দেন।
এই হিসাব নম্বরে ২০১৫ সালের ২১ জুন থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৫ দফায় ৭৫ লাখ টাকা নেন। পরে বিভিন্ন সময়ে বাদী দেলোয়ার হোসেন তার এক্সিম ব্যাংক পল্টন শাখার ০৪৫১৩১০০০২৮০৬৫ নম্বর হিসাব থেকে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক করপোরেট শাখার ০০৭৩৩০০০০০২৮৩ নম্বর হিসাব থেকে ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা, যমুনা ব্যাংক দিলকুশা শাখার ০০৬০২১০০২০৭৬৫ নম্বর হিসাব থেকে ১ কোটি টাকা, উত্তরা ব্যাংক ফুলবাড়িয়া শাখার ০০১২২০০২১১৩৭৭ নম্বর হিসাব থেকে ১৬ কোটি ২০ লাখ ৫৭৫ টাকাসহ মোট ৩৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৭৫ টাকা আসামি মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের মনোনীত ব্যক্তিদের দেন। তারা নগদ টাকা ও ক্যাশ চেক পে অর্ডারে রূপান্তর করে বিভিন্ন কোম্পানির হিসাব নম্বরে স্থানান্তর করেন।
আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তদন্ত শেষ করতে না পারায় আদালতের কাছে দুই দফা সময় বাড়িয়ে নিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
২৯ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার দিন ধার্য আছে। দেলোয়ার হোসেনের আইনজীবী আয়শা আক্তার আশা যুগান্তরকে বলেন, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, চাকরিচ্যুত প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার, সাবেক উপসহকারী প্রকৌশলী মাজেদ, কামরুল হাসান, হেলেনা আক্তার, আতিকুর রহমান স্বপন এবং ওয়ালিদ পরস্পর যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ঘুস নিয়েছেন। এ কারণে প্রতারণা, জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গ, ষড়যন্ত্রসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আদালত পিবিআইকে মামলার তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। তারা তদন্তের জন্য সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক লোকমান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর। তদন্তাধীন বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
তথ্যানুসন্ধানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন তারা শেষ হয়ে গেছেন। দেলোয়ার হোসেন দোকান বরাদ্দের নামে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে দিয়েছেন। তারা দাবি করেন, তাদের আর কিছুই নেই।
জাকের সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হিসাবে দেলোয়ার হোসেনের সই করা লিখিত একটি অনুমতিপত্রের ভিত্তিতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা মার্কেটের খালি জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ করা দোকান বরাদ্দ নিয়েছিলেন।
এসব দোকান বৈধ করার আশ্বাস দিয়েই কোটি কোটি টাকা নিয়েছিলেন সাঈদ খোকন। সমিতির সভাপতি হিসাবে দেলোয়ার হোসেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলে নিজের হিসাব নম্বর থেকে লেনদেন করেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সি ব্লকের তৃতীয় তলার ৬৫ নম্বর দোকানের মাঝখানে সিঁড়িসংলগ্ন জায়গায় ৬৫ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান নির্মাণ করে তার নামে বরাদ্দ দিয়ে ৩৭ লাখ টাকা নেন।
আরেক ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম জানান, গ্রাউন্ড ফ্লোরের উত্তর পাশের মাঝখানে ২৭ নম্বর দোকানসংলগ্ন সিঁড়ির পাশের খালি জায়গায় মাত্র ৫০ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান বানিয়ে তাকে বরাদ্দ দিয়ে নেওয়া হয় ১৭ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সি ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরের মেইন গেটসংলগ্ন ৬৫ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান তৈরি করে ৩০ লাখ টাকা নেন দেলোয়ার হোসেন।
ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, দ্বিতীয় তলায় সি ব্লকের উত্তর পাশে ১২ নম্বর দোকানের পাশে খালি জায়গায় ৪০ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান দিয়ে তার কাছ থেকে নেওয়া হয় ১৮ লাখ টাকা।
এভাবে মার্কেটের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন তলার কমন স্পেস দখল করে ৯১১টি দোকান সর্বনিম্ন ১০ ও সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকায় বরাদ্দ দিয়ে দেড়শ কোটির বেশি টাকা পকেটে তোলেন দেলোয়ার হোসেন ও তার সহযোগীরা।
এ দোকানগুলো বৈধ করার জন্যই সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে বিভিন্ন সময় ১০০ কোটি টাকা দেন বলে দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা লেনদেন হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যুগান্তরের হাতে।
সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠজনদের অভিযোগ, মেয়র থাকাকালে সাঈদ খোকন অবৈধ পথে উপার্জন করা বেশিরভাগ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। সে সময় তিনি যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে মাঝেমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া যাতায়াত করেছেন তার নম্বর ডিসি-৬০০২৪৬৯।
একই পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি সিঙ্গাপুর গেছেন। সেখানে অভিজাত হোটেল মেরিনা বে সেন্ডসে দফায় দফায় থাকেন এবং সেই হোটেলের নানা ধরনের সুবিধা ভোগ করেন। সেখানে ক্যাসিনোও আছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এসব বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে।