খুঁড়িয়ে চলছে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি নিয়মিত ভার্চুয়াল বৈঠক করলেও বাস্তবে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ১৯ সদস্যের এ কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য। শারীরিক অসুস্থতা ও বিদেশে অবস্থান করায় চারজন সব সময়ই থাকেন অনুপস্থিত।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে কর্মসূচি গ্রহণে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনায় কেন্দ্রীয় দিকনির্দেশনা প্রদানেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে যত দ্রুত সম্ভব শূন্য পদগুলো পূরণের চিন্তা-ভাবনা করছে হাইকমান্ড। দলটির বিভিন্ন স্তরের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, বিএনপির মতো এতবড় একটি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এমন অবস্থা থাকা উচিত নয়। এই দলের অনেক মেধাবী, যোগ্য অপেক্ষাকৃত কম বয়সি নেতৃত্ব রয়েছে। শিগগিরই দলের জাতীয় কাউন্সিল না হলে শূন্য পদে তাদের জায়গা দেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চাইলে স্থায়ী কমিটিতে শূন্য পদ পূরণ করতে পারেন। এছাড়া দলে আরও বেশ কিছু শূন্য পদ রয়েছে। সেগুলোও পূরণ করতে পারেন।
স্থায়ী কমিটির একজন ও কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন ভাইস-চেয়ারম্যান প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে যুাগন্তরকে জানান, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি ৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। তারা হলেন- তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। যদিও তার পদত্যাপত্র বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করা হয়নি। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই হিসাবে এখন সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও আইনি জটিলতাসহ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার রাজনীতিতে ফেরাটা অনিশ্চিত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকেই ভার্চুয়ালি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মামলা জটিলতায় সালাহউদ্দিন আহমেদ রয়েছেন ভারতের শিলংয়ে। অসুস্থ আছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। বয়সের কারণে বৈঠকে নিয়মিত নন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার।
জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমি অনেক আগে থেকেই বলছি, বিএনপিতে যারা বয়স্ক, শক্তি নেই- তাদের স্থায়ী কমিটিতে রাখার দরকার নেই। তাদের দিয়ে কি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কৌশল ঠিক করা যাবে? স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও মাঠে থাকতে হবে। তাহলে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবে। কিন্তু স্থায়ী কমিটিতে এখন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের মতো বয়স্ক ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার মতো অসুস্থ কয়েকজন আছেন। তাদের বয়স বেশি হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের শিরাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। স্থায়ী কমিটিতে ইয়াংদের জায়গা দিতে হবে এবং অবিলম্বে জাতীয় কাউন্সিলর করা উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, প্রথমত বিএনপি অনেক ক্ষেত্রেই এক ধরনের নেতৃত্ব শূন্যতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দলটিতে চলছে একটা ঢাকাকেন্দ্রিক নেতৃত্ব, লন্ডন থেকে আরেকটা নেতৃত্ব। ফলে সব মিলিয়ে দলে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই যেভাবে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করা দরকার তা হচ্ছে না। যে কারণে সঠিক নেতৃত্ব পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্বকে আরও সামনে নিয়ে আসা উচিত। এ দলে অনেক তরুণ নেতৃত্ব আছে যারা যোগ্য, কিন্তু অবহেলিত। তাদের সামনে আনা হচ্ছে না। লন্ডন নেতৃত্ব বলেন, আর ঢাকার নেতৃত্ব বলেন তারা নিশ্চয়ই জানেন কারা সাম্প্রতিক সময়ে দলে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন একটা নেতৃত্ব আনতে হবে যারা আগামী ১০ বছর দলকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারবে। সেক্ষেত্রে যারা বয়স্ক, ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন না তাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা প্রয়োজন। না হলে বিএনপি এক ধরনের নেতৃত্ব শূন্যতার মধ্যে দিয়ে যাবে, দলকে চাঙ্গা করতে পারবে না।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের মার্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাউন্সিলের উদ্যোগ নেয়নি দলটি। এর মধ্যে আবার গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছে। সবকিছু মিলে শিগগিরই জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বলে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, দলের স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণের বিষয়ে ইতোমধ্যে হাইকমান্ড কাজ শুরু করেছেন। শিগগিরই এ পদে নিয়োগ দেয়া হতে পারে। দুর্দিনে যারা বিএনপির, বিশেষ করে জিয়া পরিবারের পাশে ছিলেন এবং নানা প্রতিকূল পরিবেশেও দল ছাড়েননি- এমন পরীক্ষিত নেতার মাধ্যমে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণ করা হবে।
আরও জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ, বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নাম আলোচনায় রয়েছে।