রাজধানীর খাল উদ্ধারে পদে পদে বাধা
সরকারের উদাসীনতা, প্রভাবশালীদের ছোবলে দখল ও ভরাট হয়ে গেছে ঢাকার দুই সিটির অনেক খাল। যে কটি টিকে আছে সেগুলোরও নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই।
সীমানা নির্ধারণ করা নেই অধিকাংশের। বহুতল ভবন, সড়কসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে। ফলে মূল সীমানা ধরে খালগুলো উদ্ধারে পদে পদে বাধার মুখে পড়ছে ঢাকার দুই সিটি।
এগুলো উচ্ছেদের মাধ্যমে খাল দখলমুক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। দু-একটি খালের কিছু অংশ পরিষ্কার করে পানির প্রবাহ তৈরি করা হয়েছে। তবে অধিকাংশের উদ্ধার প্রক্রিয়া নানা বাধার মুখে আটকে আছে।
আবর্জনা ফেলায় মাঝপথে খালের গতি রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতে শহরের চারপাশের নদীর সঙ্গেও অধিকাংশ খালের সংযোগ কাটা পড়েছে। এর পরিণতি ভোগ করছেন এ শহরের দুই কোটি বাসিন্দা। তারা সামান্য বৃষ্টিতেই জলজট ও জলাবদ্ধতার মতো দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। দুই সিটি দায়িত্ব পাওয়ার পর খালের প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পরিচ্ছন্নতা ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি তারা।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো দখলমুক্ত করে মূল আয়তন ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন। এক্ষেত্রে সিএস এবং আরএস রেকর্ড বিবেচনায় নিয়ে তারা কাজ করছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে মন্ত্রণালয়।’
তিনি বলেন, ‘যেসব খাল ভরাট করে সরকার সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি করেছেন। সেগুলো এখন ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক। সেসব ক্ষেত্রে হয়তো আমাদের ছাড় দিতে হবে। এসব সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাবছি। দুই মেয়রও চিন্তাভাবনা করছেন। তবে খালগুলোর টেকসই উন্নয়ন করতে আমরা বদ্ধপরিকর। সে লক্ষ্যে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার খালগুলোর বিদ্যমান বেহাল থেকে মুক্ত করতে সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) রেকর্ড ধরে উদ্ধার কাজ শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে খালগুলোর সংযোগ নিশ্চিত করে চারপাশের নদীর (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
তবেই পানি নিষ্কাশন কার্যক্রমের অগ্রগতি হবে। তবে রাজধানীর খাল উদ্ধারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে এখনো কার্যকর কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারেনি। রুটিন উচ্ছেদ ও খাল পরিষ্কারের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কয়েকদিন পর আবারও এসব খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালগুলোর টেকসই উন্নয়ন ও প্রবহমান করতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দুই সিটিকে সামনে এগোতে হবে।
তারা বলেন, এক সময় ঢাকায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিল আঁকাবাঁকা খাল, বিল ও ঝিল। বৃষ্টি হলে পানি খাল, বিল ও ঝিল হয়ে নদীতে পড়ত। পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে পরিষ্কার হতো শহর।
কিন্তু বিগত তিন দশকের ব্যবধানে রাজধানীর এসব খাল ও জলাভূমি দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছরই মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিতে রাজধানীর রাস্তাঘাটে জলজট ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। খালের প্রবাহ নিশ্চিত করে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, রাজধানীর খালের সংখ্যা ৫৮। বেসরকারি গবেষণায় কখনো ৫২, কখনো ৪৬টির কথা বলা হয়েছে। তবে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঢাকার দুই সিটির আওতাভুক্ত খালের সংখ্যা ৩৯টি। ইতোমধ্যে ২৬টি খালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুই সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শিগগিরই বাকি ১৩টি খালের দায়িত্ব দুই সিটিকে হস্তান্তর করতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এ খালগুলো সিএস রেকর্ড ধরে সীমানা নির্ধারণ করা হবে। এ লক্ষ্যে কাজ করেছে ঢাকার দুই সিটি। এরপর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে খালের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে খালের পারে ওয়ার্কওয়ে, সাইকেল লেন ও সবুজায়ন করা হবে।
রাজধানীর পশ্চিমাংশের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোর মধ্যে রয়েছে : কাঁটাসুর, হাজারীবাগ, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, আব্দুল্লাপুর, রামচন্দ্রপুর, বাউনিয়া, দ্বিগুণ, দিয়াবাড়ী, ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, বাইশটেকি ও শাহজাহানপুর খাল। আর পূর্বাংশের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোর মধ্যে রয়েছে : জিরানী, মাণ্ডা, মেরাদিয়া, গজারিয়া, কসাইবাড়ী, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা ও খিলগাঁও-বাসাবো খাল।
এ প্রসঙ্গে প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার খাল, ড্রেনেজ এবং বক্স কালভার্ট ব্যবস্থার দায়িত্ব ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটির কাছে নিয়ে আসাটা এক ধাপ অগ্রগতি বলা যায়। তবে শহরের টেকসই পানি নিষ্কাশন নকশা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। সে কারণে আমার মতে শহরের ড্রেনেজ, খাল এবং বক্স কালভার্টের দায়িত্ব সিটির হাতে থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে। কেননা এসব কাজের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড বেশি কার্যকর সংস্থা।’
তিনি বলেন, ‘সিএস রেকর্ড ধরে ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। একই সঙ্গে এসব খালের সঙ্গে রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর কার্যকর সংযোগ ঘটাতে হবে। তাহলে রাজধানীর জলজট ও জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব হবে।’
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘ওয়াসার কাছ থেকে খাল বুঝে নেওয়ার পর দুই সিটির উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। দুই নগর সংস্থা চেষ্টা করছে বিদ্যমান খালগুলোর প্রবাহ ঠিক রেখে ধাপে ধাপে খালের দখল ও দূষণমুক্ত করা এটা ঠিক আছে।’
তিনি বলেন, ‘খালগুলো দখল, দূষণ রোধ করে প্রবাহ ঠিক রাখতে কোথাও কোথাও নতুন নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে সিএস এবং আরএস রেকর্ড ধরে খাল উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তাহলে নতুন করে জমি অধিগ্রহণের খুব প্রয়োজন পড়বে না। অনেক ক্ষেত্রে খালের জমি মহানগর জরিপে ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডও করে ফেলা হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. বদরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, খাল উদ্ধার ও প্রবাহ নিশ্চিত করতে পদে পদে বাধা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বেশিরভাগ খালের সীমানা নির্ধারণ করা নেই।
সিএস রেকর্ড ধরে এসব খালের সীমানা নির্ধারণ করা এবং অবৈধ ঘরবাড়ি ও স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। এছাড়া এসব অবৈধ স্থাপনায় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ রয়েছে। সেসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো এসব সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধ বিবেচনা না করেই সংযোগ দিয়েছে।
একই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এম সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, খাল উদ্ধার ও প্রবহমান করতে নানাবিধ বাধার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, নগরবাসী সচেতন নন। এজন্য তারা গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলে খাল ভরাট করছে। এছাড়া বিগত ৩০-৪০ বছর ধরে খালগুলোর সঠিক পরিচর্যা না হওয়ায় সংযোগগুলোও কার্যকর নেই।
খালের সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি, সিএস রেকর্ড ধরে খালের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। এরপর এগুলো দখলমুক্ত করে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। আমরা আবর্জনা পরিষ্কার ও দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করেছি। এটার বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। ডিএনসিসি সেটা মোকাবিলা করে সামনে এগোবে।
বেদখল খাল : সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন খাল দখলের চিত্র সরেজমিন ঘুরে দেখেছে যুগান্তর। পুরাতন দখলের পাশাপাশি অনেক খালে নতুন করেও দখলযজ্ঞ চলছে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালসংলগ্ন কল্যাণপুর খালের অংশ নতুন করে দখল শুরু করেছে প্রভাবশালী মহল। রাতের আঁধারে মাটি ফেলে তারা খাল ভরাট করছেন।
দেবধোলাই খাল ভরাট করে পিচ ঢালাই সড়ক নির্মাণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির নির্মিত সড়কের পাশে বা মাঝখানে দিব্যি রয়েছে খালের সীমানা পিলার। এমন স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও সেখানে পিচ ঢালাই সড়ক তৈরি করেছে ডিএসসিসি। প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক বেশ কয়েকটি পিলার লক্ষ্য করা গেছে।
মহানগরীর ঢাকা-ডেমরা মহাসড়কের কাজলার পার এলাকা থেকে শুরু হয়ে দেবধোলাই খাল মিশেছে মাণ্ডা খালে। এ খালের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৯-২৫ মিটার।
স্থায়ী বাসিন্দারা জানান, ওই খালের পাশের বাসিন্দারা কোনোরকম সড়কের জায়গা না রেখেই বহুতল ভবন তৈরি করেছে। তারা সবাই মিলে খালের জায়গা ভরাট করে কাঁচা রাস্তা তৈরি করেন। ইউনিয়ন পরিষদ ওই সড়ক ইট বিছিয়ে দেয়। এরপর সিটি করপোরেশনে এলে স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুরোধে ডিএসসিসি সেটা পাকা করেছে। নির্মাণ কাজের সময় বাধা দিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা।
রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরাদিয়া বাজারমুখো প্রবাহিত বেগুনবাড়ী খালের বনশ্রী আবাসিক এলাকাসংলগ্ন অংশবিশেষ দখল করে ফুটপাত তৈরি করেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল পর্যন্ত ফুটপাত তৈরি করেছে ডিএনসিসি। অন্যদিকে বনশ্রী ‘বি’ ব্লকসংলগ্ন খালের জায়গা ভরাট করে আবর্জনার কনটেইনার বসিয়েছে ডিএনসিসি।
এছাড়া রামচন্দ্রপুর খালের মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ১ নম্বর ব্রিজের পশ্চিম পাশে খালের অংশবিশেষ ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। মিরপুরের রূপনগর খালের অর্ধেক ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে সড়ক। ভাসানটেক আবাসন প্রকল্পের আওতায় খালটির একটি অংশ দখল করে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। কল্যাণপুর ‘খ’ খাল ভরাট করে সড়ক নির্মিত হয়েছে।
কল্যাণপুর ‘চ’ খালের আগারগাঁও এলাকার খালের অংশবিশেষ দখল করে অবৈধভাবে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থাই এ কাজগুলো করেছে।