উগান্ডার নির্বাচন ও বিএনপির ভোটতলা গমন

বাংলাদেশে যখন পৌরসভা নির্বাচন হচ্ছে, তখন উগান্ডার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বেরিয়ে গেছে। সেই নির্বাচনে ৩৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইয়োয়েরি মুসেভেনি ষষ্ঠবারের মতো জয়ী হয়েছেন। মুসেভেনির মতো সুখী নেতা পৃথিবীতে আর একজনও নেই। ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়া এই ৭৬ বছর বয়সী নেতা কত যুদ্ধ, কত বিপ্লব, কত মৃত্যু দেখেছেন, দেখেছেন সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, বাঘা বাঘা বিশ্বনেতার প্রস্থান। অনেক হাতি-ঘোড়া তলিয়ে গেলেও তিনি নাক উঁচু করে আছেন।

ক্ষমতাই তো নেতাদের যৌবন। ৭৬ বছর বয়সেও তাই তিনি সেনাবাহিনীর সহায়তায় হারিয়ে দিয়েছেন উগান্ডার যৌবনের প্রতীক রকস্টার ববি ওয়াইনকে। দেশের বিরোধী দলকে বিনাশ করে ফেলায় যখন আর কেউ ছিল না তাঁকে চ্যালেঞ্জ করবার, তখন ববি ওয়াইন জনপ্রিয় রকস্টার থেকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে মুসেভেনির প্রতিদ্বন্দ্বী হন। ববি ওয়াইন দাবি করেছেন, কারচুপি করে তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকেই গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে তাঁকে। ওদিকে উগান্ডার রাজধানী কামপালার রাস্তায় চলছে মুসেভেনির সমর্থকদের মোটর শোভাযাত্রা।

এদিকে বাংলাদেশে পৌরসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হয়েছে। আরও তিনটি অধ্যায়ে এই কাহিনি শেষ হওয়ার কথা। প্রথম দুই পর্বের ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। প্রথম পর্বে ২৬টি পৌরসভার মধ্যে ১৬টিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ এবং ২টিতে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হন। দ্বিতীয় পর্বে ৬০টির মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৪৬টি এবং বিএনপির প্রার্থীরা ৪টিতে জয়ী হন। স্বতন্ত্র ও অন্য প্রার্থীরা জিতেছেন ৯টিতে। বলাবাহুল্য, স্বতন্ত্রদের বেশির ভাগই বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের নেতা। সুতরাং নির্বাচন ব্যাপারটা এখন আমরা আর আমাদের মামুদের গল্প হয়ে গেছে। বিএনপি সেখানে সাক্ষীগোপাল মাত্র।

জয়ের আশা না করেও যিনি লড়ে যান, তাঁকে বলে সংশপ্তক। সংশপ্তকের পরিণতি ট্র্যাজিক হয়। কিন্তু সেই ২০১৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়া বিএনপিকে কি ট্র্যাজিক বলা যাবে, নাকি তারা কমেডির চরিত্র হয়ে উঠছে? নিয়ম রক্ষার জন্য সরকারের না হয় নির্বাচন দরকার, কিন্তু বিএনপি কেন নির্বাচনের বলিকাঠে সেধে মাথা রাখে? এমন হবে জেনেই বুঝি সাহিত্যিক সুকুমার রায় ছড়ায় ছড়ায় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায়’। প্রশ্নটা নিয়ে ভারি ধন্দে পড়েছিলেন সুকুমার রায়ের ছড়ার এক রাজা। রাজা প্রশ্ন শুধান,
লেখা আছে পুঁথির পাতে, ‘নেড়া যায় বেলতলাতে, ’
নাহি কোনো সন্দ তাতে—কিন্তু প্রশ্ন ‘কবার যায়?’
এ কথাটা এদ্দিনেও পারে নিকো বুঝতে কেও,
লেখে নিকো পুস্তকেও, দিচ্ছে না কেউ জবাব তায়।
(আবোল তাবোল)

ন্যাড়াকে নিয়ে রাজার এত ভাবনা কেন? নিশ্চয়ই রাজার তাকে নিয়ে কোনো কাজ আছে। এ কথা তাই বলা যায় না যে ন্যাড়া বেলতলায় গেলেই কী, আর না গেলেই কী। ন্যাড়াকে বেলতলায় আনতে পারলে পুনরায় তার মাথায় বেল ফেলার ব্যবস্থা করা যায়। আর সেই উপায়ও রাজার ভালো করেই জানা।

কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে বলেছিলেন, ফল আশা না করে তুমি লড়ে যাও। বিএনপিও প্রতিবারই তার কর্মীদের বলেছে, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। ফল লাভের আশা না করেই? ফল নাই কে বলল? ফলটা হলো গণতন্ত্রের বিরাট বড় বেল, এই ফলটি আরও পুরু ও ভরাট হওয়া। এবং দিনের শেষে ন্যাড়া যখন বেলতলায় আবার যায়, তখন সেই ফল প্রণয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফলটি তার মাথাতেই পড়ে।

জাতীয় বা আঞ্চলিক প্রতিটি নির্বাচনের পরে বেলপড়া মাথায় বিএনপিকে আরও বিধ্বস্তই দেখায়। এমনকি নিষ্ফলা নির্বাচনে দু-একটি আসনও যদি বা তারা পায়, সেই সব সংসদীয় আসনের অধিকারীদের কাউকে কাউকে সরকারি দলে যোগদান থেকে বিরত রাখাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। সুকুমার রায়ের ছড়ার ন্যাড়াকে বেলতলায় কতবার দেখা যায় তার হিসাব পাওয়া যায়:
‘নেড়াকে তো নিত্যি দেখি আপন চোখে পরিষ্কার—
আমাদেরি বেলতলা সে নেড়া সেথা খেলতে আসে
হরে দরে হয়তো মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার।’

বিএনপির ভোটতলায় আত্মদানের গল্পটা চলমান। হালফিল বাংলাদেশে নির্বাচনের গল্পের শেষটা মোটামুটি সবারই জানা। তাই শ্রোতা-দর্শকও বেজায় কম। এমনকি গণতন্ত্রের মহামান্য যে ভোটারবৃন্দ, তাঁরাও আজকাল ভোট দিতে বিস্তর কম আসছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারির পর জাতীয় বা আঞ্চলিক যত নির্বাচন হয়েছে, তাতে সবকিছুই কম। প্রার্থী কম, ভোটও কম, আশাও কম। এত কম যে গণতন্ত্র নিজেই লজ্জা পেয়ে মুখ লুকায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসল-নকল মিলিয়ে ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ। এর বেশি দেখাতে পারেনি তখনকার নির্বাচন কমিশন। তাতে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪৬ জনের বিনা চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেবার ক্ষমতাসীন দলের ২৬৫ জন বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। ২০১৮ সালের শেষের নির্বাচনে আরও কম ভোটার হলেও এক দলের সর্বাধিক প্রার্থী-২৯২ জন জয়ী হন। ইতিহাসে তা নৈশ ভোট হিসেবে খ্যাত।
বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কখনো আগে ঘটেনি। কোনো নির্বাচন কমিশনও লাগাতারভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মাটিয়ে শুইয়ে দিতে পারেনি। নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ে অভূতপূর্ব আরেকটি ঘটনাও সম্প্রতি ঘটেছে। ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি ও অনিয়ম বিষয়ে তদন্তের জন্য সংবিধানের ৯৬ ধারা সক্রিয় করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। এই ধারায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিটি গঠনের বিধান দিয়ে রেখেছে। এতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, নির্বাচন কমিশন ও অন্য সাংবিধানিক পদাধিকারীদের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তকাজের জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারককে নিয়ে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিটি বা এসজেসি গঠিত হবে।

এই নাগরিকেরা তাঁদের আবেদনের সঙ্গে আট পৃষ্ঠার একটি স্মারকও জমা দিয়েছেন। তাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি, গাড়িসহ অবৈধ সুবিধা গ্রহণ, অনিয়মের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তদন্তে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হবে।’

যখন রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের জীবননালি হিসেবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ, তখন বিভিন্ন পেশা ও অবস্থানের নাগরিকদের এই ফরিয়াদ গণতন্ত্রের প্রকৃত জিম্মাদার হিসেবে নাগরিকদের দায়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তাঁরা অন্তত বিএনপির মতো সাজানো নির্বাচনের সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় থাকেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *