জাল স্ট্যাম্পের কোটি টাকার কারবার
মূল সড়ক থেকে গলিতে ঢুকে কিছুটা যাওয়ার পর উপগলি। সেই পথ ধরে অনেকটা এগোনোর পর আবার পার্শ্বগলি। এভাবে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল জেবি প্রিন্টার্স। রাজধানীর ফকিরাপুলের শুক্কুর পাগলার গলির এই প্রেসে ছাপা জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছড়িয়ে পড়ত সারাদেশে। প্রেসের মালিক নূর ইসলাম নিজেই এ কাজের সমন্বয় করত। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত শাটার নামিয়ে ভেতরে ছাপা হতো জাল স্ট্যাম্প। চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর এখন বন্ধ আছে প্রেস। নূর ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেল। আশপাশের ছাপাখানার মালিক-কর্মীরা জানালেন, জরুরি সরবরাহের অর্ডার থাকায় রাতভর ওই প্রেসে কাজ চলত বলে ভাবতেন তারা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে গুঞ্জন শুনলেও তারা বিশ্বাস করেননি, ওখানেই ছাপা হয় জাল স্ট্যাম্প! ফকিরাপুলের কয়েকটি ছাপাখানার মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শুধু জেবি প্রিন্টার্স নয়; আরও কিছু ছোট ছাপাখানায় গোপনে জাল রাজস্ব স্ট্যাম্পসহ অবৈধ বিভিন্ন জিনিস ছাপা হয়। যেমন কেউ নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল মোড়ক ছাপে, কেউ ভুয়া সনদ বা অন্য কোনো নথিপত্র। বিশেষ করে রাতে ছাপাখানায় নজরদারি না থাকার সুযোগ নেয় তারা। তাদের কথার সত্যতা পাওয়া গেল পুলিশের তদন্তসংশ্নিষ্টদের বক্তব্যেও। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, স্ট্যাম্প জালিয়াত চক্রের অন্যতম হোতা দেওয়ান মাসুদ রানা গত পাঁচ বছরে অন্তত তিনটি প্রেস থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছাপিয়েছে। ঢাকাসহ সাত জেলায় তার ২০-২৫ জন কমিশনভোগী এজেন্ট রয়েছে। এই চক্রে আছে অসাধু ভেন্ডররাও।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার এস.এম. শামীম সমকালকে বলেন, অনেক দিন ধরেই মাসুদের চক্রটি জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছেপে বিক্রি করে আসছিল। প্রায় নিখুঁত হওয়ায় সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে বোঝা কঠিন, সেগুলো আসল নয়। এতে ক্রেতারা যেমন প্রতারিত হচ্ছিলেন, তেমনি বিপুল রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
এদিকে জাল স্ট্যাম্প ব্যবহার করে কোনো চুক্তি বা আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তার বৈধতা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। অনেকে বলছেন, জাল স্ট্যাম্পযুক্ত নথির কোনো বৈধতা নেই। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী ও ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নকল স্ট্যাম্প জব্দ বা জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে পারে। সেটি অন্য বিষয়। তবে কোনো চুক্তি বা আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবহূত স্ট্যাম্প নকল দাবি করলে, তা আগে আদালতে প্রমাণ করতে হবে। তারপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
১১ জনের চক্র :চক্রের প্রধান মাসুদ রানা নিজেই কম্পিউটারে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির নকশা তৈরি করে পাশাপাশি বসিয়ে ছাপার উপযোগী আকারে ‘মেকআপ’ দিত। এরপর তা পাঠাত জেবি প্রিন্টার্স বা অন্য কোনো ছাপাখানায়। এজেন্ট বা বিক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছাপানো হতো। এরপর তা মজুদ করা হয় রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচার ১ নম্বর গেট এলাকার একটি বাসায়। মাসুদ নিজেও সেখানে থাকত। এর আগে একাধিকবার জালিয়াতি করে ধরা পড়লেও সে জামিনে বেরিয়ে পুরোনো কাজে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে ধরা পড়ার পর তার বিরুদ্ধে মিরপুর ও আশুলিয়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। সর্বশেষ রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থেকে মাসুদকে গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে জাল টাকা ও পাসপোর্ট পাওয়া যায়। তবে সে দাবি করে, নকল টাকার কারবার করে তার পরিচিত সেন্টু নামে একজন। জাল পাসপোর্টটি একজনকে দেওয়ার জন্য তার কাছে রাখা হয়েছিল। এর আগের দিন সেগুনবাগিচা থেকে ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী হিসাবরক্ষক আলফাজ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে রমনা থানা পুলিশ। সে বিবির বাগিচার ৪ নম্বর গেট এলাকায় থাকে। আলফাজ দাবি করে, করোনা পরিস্থিতি শুরুর কিছুদিন আগে থেকে সে মাসুদের মাধ্যমে পাওয়া স্ট্যাম্প বিক্রি করে আসছিল। তবে এগুলো বিজি প্রেস থেকে ছাপা হয়ে আসত বলে তার জানা ছিল। তার কাছে পাওয়া যায় এক লাখ ২০ হাজার টাকার জাল স্ট্যাম্প।
মাসুদ ও আলফাজকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ এ চক্রের আরও কয়েকজনের সন্ধান পায়। তাদের একজন হলো জেবি প্রিন্টার্সের কর্মী রোজিনা আক্তার। সে নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির নমুনা আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিত। এর পর চাহিদা অনুযায়ী মূল চালানও সরবরাহ করত। গত ২ সেপ্টেম্বর তাকে ও প্রেসের আরেক কর্মী আরিফুল ইসলাম অভিকে ফকিরাপুল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিনে এ চক্রের আরেক জালিয়াত হাবিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হাবিব জাল নোটের কারবারেও যুক্ত। তাদের কাছে মোট ১৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি পাওয়া যায়। এর আগের অভিযানে জব্দ করা হয় চার কোটি ৮৬ লাখ টাকার স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি। এগুলো ছাপানোর কাজে ব্যবহূত প্লেট ও ফিল্ম পাওয়া গেছে। অভিযানে মাসুদের বাসায় ছাপা ও ছাপার উদ্দেশ্যে রাখা বিশেষ ধরনের প্রচুর কাগজও পাওয়া যায়।
এই পাঁচজন ও প্রেস মালিক নূর ইসলাম ছাড়াও চক্রের আরও অন্তত পাঁচ সদস্যের ব্যাপারে তথ্য পেয়েছেন তদন্তসংশ্নিষ্টরা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তাদের অবস্থান বলে জানা গেছে। তারা জাল স্ট্যাম্প বিক্রির সঙ্গে জড়িত।
দুই হাজার টাকার স্ট্যাম্প ২০০ টাকায় :এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই শহিদুল ওসমান মাসুম জানান, খুব অল্প দামে কিনে অনেক বেশি লাভে বিক্রি করা যায় বলেই মূলত জালিয়াতির কারবারে জড়ায় অনেকে। দুই হাজার টাকা দামের কোর্ট ফি বা স্ট্যাম্প পাইকারি বিক্রি হয় মাত্র ২০০ টাকায়। প্রেসে ব্যবহূত একটি প্লেটে ৫০ হাজার স্ট্যাম্প ছাপা যায়। ছাপা একটি পাতায় সাধারণত ২০০ স্ট্যাম্প থাকে। এক পাতায় কোর্ট ফি ছাপা যায় ৪০টি। এ রকম একটি পাতা ছাপতে খরচ হয় মাত্র ৩০ টাকা। ফলে গায়ের দামের চেয়ে কমে বিক্রি করেও চক্রের সদস্যরা অনেক টাকা হাতিয়ে নিতে পেরেছে।
বিভিন্ন জেলায় এজেন্ট :তদন্তসংশ্নিষ্টরা জানান, গ্রেপ্তার অভিযানে মাসুদের একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। তাতে দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু মানুষের নাম ও ফোন নম্বর রয়েছে। এই ব্যক্তিরা জাল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি বিক্রির এজেন্ট বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান ছাড়াও গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থানরত এই এজেন্টদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
নজরদারির অভাবে অবৈধ মুদ্রণ :ফকিরাপুলের বিভিন্ন ছাপাখানায় ঘুরে মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা কারণে কিছু অসাধু প্রেস মালিক জাল স্ট্যাম্পসহ অবৈধ জিনিসপত্র ছাপে। অনেকে সারাবছর পর্যাপ্ত কাজ না পাওয়ায় খুব সমস্যায় পড়ে। তাদের কেউ কেউ বেশি লাভের আশায় অনৈতিক কাজের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
ফকিরাপুলের শুক্কুর পাগলার গলিতে একটি সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয় ও প্রেস রয়েছে। নাম না প্রকাশের শর্তে প্রতিষ্ঠানটির মালিক জানালেন, যথাযথ নজরদারির অভাবে কোনো কোনো প্রেস এসব ছাপার সুযোগ পায়। বিশেষ করে রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর সব প্রেস বন্ধ হয়ে যায়। তখনও জরুরি কাজের অজুহাতে কেউ কেউ থেকে যায়। অনেকেরই ধারণা, রাতে লোকজন কম থাকার সুযোগে অসাধু প্রেস মালিকরা অবৈধ জিনিসপত্র ছাপে। অবৈধ মুদ্রণ রোধে ছাপাখানাগুলোয় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
জেবি প্রিন্টার্সের সামনেই ‘আল মদিনা ফয়েল’ নামে একটি ছাপাখানা। সেখানকার কর্মীরা জানান, প্রায়দিনই রাতভর কাজ চলত জেবি প্রিন্টার্সে। শাটার নামানো থাকায় কী কাজ চলছে, তা বাইরে থেকে দেখা যেত না। তবে সেসব রাতে সাধারণত প্রেসের মালিক নূর ইসলাম উপস্থিত থাকত।
পাশের তানহা এন্টারপ্রাইজের মালিক প্রথমে এ নিয়ে কথা বলতে চাননি। পরে জানালেন, কোনো কোনো প্রেসে অবৈধ কিছু ছাপা হয় বলে তিনি শুনেছেন। তবে তিনি কখনও বুঝতে পারেননি, তার পাশের প্রেসেই এমনটা হচ্ছে। পুলিশ সেখানে অভিযান চালানোর সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। জাল স্ট্যাম্প জব্দের ঘটনায় তাকে সাক্ষী করা হয়েছে।
জাল স্ট্যাম্প চেনা কঠিন :বাংলাদেশ স্ট্যাম্প ভেন্ডর সমিতির সভাপতি সুব্রত কুমার দে সমকালকে বলেন, স্ট্যাম্প বিক্রি করতে হলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। বৈধ ভেন্ডর হয়েও যদি কেউ বেশি লাভের আশায় জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও সমিতির পক্ষ থেকে শক্ত নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে এটাও ঠিক যে, সাধারণ ক্রেতা বা ভেন্ডরের পক্ষে জাল স্ট্যাম্প শনাক্ত করা কঠিন। এসব জাল স্ট্যাম্প ব্যবহার করে সম্পাদিত দলিলপত্র বৈধ হবে না।