বিতর্কে ভরা ম্যারাডোনার জীবন
ফুটবল মাঠে শিল্পীর কারুকাজ দেখিয়ে যেমন অনেকের চোখে তিনি অন্য গ্রহের; একইভাবে নিয়মিত বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে জানিয়েও দিয়েছেন, তিনি আদতে আর দশজনের মতোই রক্ত–মাংসে গড়া মানুষ। তাঁর মৃত্যুটাও যেন মানুষ হওয়ার আরেকটা প্রমাণ! ‘জীবিত ও মৃত’ ছোটগল্পে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’। ম্যারাডোনার ক্ষেত্রেও বলা যায়, ‘ম্যারাডোনা যেন মরেই প্রমাণ করলেন তিনি মানুষ, আর দশজনের মতোই।’
গোটা জীবনে বিতর্ক ছিল ম্যারাডোনার ছায়াসঙ্গী। এক হাতে হাভানার চুরুট থাকত তো, আরেক হাত যেন বিতর্কের হাতেই দেওয়া থাকত। তাঁর মহাপ্রস্থানের পর এখন সেসব বিতর্কের দিকে ফিরে তাকালে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, ওসব বিতর্কগুলোই তো আসলে ম্যারাডোনাকে আরও ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল!
হ্যান্ড অব গড
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলে হেরেছিল ইংল্যান্ড। এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার প্রথম গোলটি হাত দিয়ে করেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। পরে যা ‘হ্যান্ড অব গড’ তকমা পেয়েছে। ম্যারাডোনা নিজেই জানালেন, ভিএআর প্রযুক্তি থাকলে ওই গোলটার জন্য তিনি গ্রেপ্তারও হতে পারতেন। মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে সেদিন ৫১ মিনিটে ইংলিশ ডিফেন্ডার স্টিভ হজের ভুলের সদ্ব্যবহার করে হাত দিয়ে গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা। হেডের ছলে তাঁর হাতের টোকায় গোল করা এতটাই নিখুঁত ছিল যে রেফারি আলী বিন নাসেরের চোখ এড়িয়ে যায়। ইংলিশরা এখনো ম্যারাডোনার সেই কাণ্ড ভুলতে পারে না। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই ‘হ্যান্ড অব গড’ বিতর্কটাই ছিল ম্যারাডোনার ছায়াসঙ্গী।
মারামারি করে বার্সা থেকে বিদায়
১৯৮৩-৮৪ মৌসুমের কোপা দেল রে’র ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বার্সেলোনা ও অ্যাথলেটিক বিলবাও। ম্যাচ হেরেছিল বার্সেলোনা। গোটা ম্যাচে ম্যারাডোনাকে বাজে ট্যাকল আর উত্ত্যক্ত করে ছেড়েছিলেন বিলবাওয়ের আন্দোনি গয়েকোয়েচিয়া। শেষমেশ আর নিজেকে আটকাতে পারেননি ম্যারাডোনা। ম্যাচ শেষে বিলবাও তারকাদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছিলেন। ঘটনাটা মাঠের লাখো মানুষ তো দেখেছিলেনই, মাঠে বসে দেখেছিলেন খোদ স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোস। এরপর বার্সেলোনা কর্তাব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আর নয়। ম্যারাডোনাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় নাপোলির কাছে।
কোকেন আসক্তি
গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই কোকেন সেবন করে গেছেন ম্যারাডোনা। বার্সেলোনা থেকে নাপোলি, সেভিয়া, বোকা জুনিয়র্স—কোনো ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরাই তাঁকে এই আসক্তি থেকে সরাতে পারেননি। কোকেন সেবনের কারণে ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ি জীবনটা শেষের দিকে এসে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে ডোপ পাপে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে নিষেধাজ্ঞা
১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে করা গোলটা ছিল মনে রাখার মতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু আরও বেশি মনে রাখার মতো ছিল তাঁর উদ্যাপন। বল জালে জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে কর্নার পতাকার দিকে ছুটে গিয়ে একটি টেলিভিশন ক্যামেরার লেন্সে মুখ রেখে বন্য উদ্যাপনটি করেছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা। সন্দেহ উঠল সেই উদ্যাপন দেখেই। কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে তো এমন মুখভঙ্গি করা সম্ভব না! খবর এল নিষিদ্ধ ওষুধ এফিড্রিনের নমুনা ছিল ম্যারাডোনার রক্তে, যে কারণে ওই উদ্যাপন। যার কারণে পরে বহিষ্কৃত হন ম্যারাডোনা। ডোপ টেস্টে প্রিয় তারকার অকৃতকার্য হওয়ার খবরটায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল ম্যারাডোনা-ভক্তদের মাথায়। এই এফিড্রিন ফিফার নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকায় ছিল।
বান্ধবীর মামলায় গ্রেপ্তার
সাবেক বান্ধবী রোচিও অলিভার সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর তাঁর করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। বিচ্ছেদের পর অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৯ মিলিয়ন ডলার বা ৭৬ কোটি টাকার মামলা করেন অলিভা। সে মামলার কারণেই মেক্সিকো থেকে ফেরার পথে গ্রেপ্তার করা হয় ম্যারাডোনাকে। স্যান মিগুয়েলের পারিবারিক আদালতে ম্যারাডোনার বিরুদ্ধে এ মামলা লড়বেন অলিভা। তবে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে আটকে রাখেনি পুলিশ। কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল।
বান্ধবীকে পেটানো
এ ঘটনাটাও ঘটেছে বান্ধবী রোচিও অলিভার সঙ্গেই। ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেখান থেকে সংবাদমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, রাগে গজরাতে গজরাতে এগিয়ে যাচ্ছেন ম্যারাডোনা। বলছেন, ‘ফোনটা রেখে দাও, ফোনটা রেখে দাও। ওটা দেখা বন্ধ করো।’ অলিভা উত্তর দেন, ‘আমি কি দেখতে পারি না?’ এরপরই ম্যারাডোনা অলিভার শরীরে আঘাত করেন। অলিভা তখন বলতে থাকেন, ‘থামো ডিয়েগো। শান্ত হও, আঘাত করা বন্ধ করো।’ ভিডিওটা করেছিলেন অলিভা নিজেই। এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠায় ম্যারাডোনা এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘ফোনটা আমি ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কসম, একজন নারীর গায়ে কখনোই হাত তুলিনি। কাহিনি এখানেই শুরু, এখানেই শেষ। রোচিওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতেই অমন করেছিলাম। এর বেশি কিছু ঘটেনি।’ তাতে বিতর্ক থেমে থাকবে কেন!
করোনায় আক্রান্ত রোগীকে জড়িয়ে ধরা
১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো এই মহাতারকা হালে আর্জেন্টিনার প্রথম বিভাগের নিচু সারির দল হিমনাসিয়ার কোচের দায়িত্বে থাকার সময়ে নিজের স্বভাবসুলভ আবেগে এক ম্যাচে নিজ দলের খেলোয়াড়কে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পরে পরীক্ষায় দেখা যায় ফুকান্দো কনতিন নামের সেই খেলোয়াড় করোনায় আক্রান্ত। ৫৯ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন তারকা করোনায় আক্রান্ত হন কি না, এ নিয়েই দুশ্চিন্তার কালো ছায়া নেমে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি যদিও। ম্যারাডোনার করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভই এসেছিল।
ম্যারাডোনার ‘ঘুম’
‘আয়াকুচো যুদ্ধে’র ১৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভেনেজুয়েলায় এক বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হয়। অনেক দিন ধরেই দেশটির বন্ধু হিসেবে পরিচিত ম্যারাডোনা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন সেই উৎসবে। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট মাদুরো জাতির উদ্দেশে টিভিতে সরাসরি ভাষণ দিচ্ছিলেন। এ সময় ম্যারাডোনা খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। মাদুরো তাঁর বক্তৃতার একপর্যায়ে ম্যারাডোনাকে ‘বিদ্রোহী, বিপ্লবী ম্যারাডোনা’ নামে উল্লেখ করেন। বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট তাঁর নাম উল্লেখ করামাত্রই ধড়ফড় করে জেগে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন আর্জেন্টিনার এই ফুটবল কিংবদন্তি। চটপট চোখ খুলে ম্যারাডোনা দাঁড়িয়ে দর্শকদের অভিবাদন নেন। তবে ম্যারাডোনা যে দুচোখ বুজে জিরোচ্ছিলেন, সেটা ঠিকই ধরা পড়ে যায় ক্যামেরায়।
অর্থহীন প্রলাপ
ঘটনাটা মেক্সিকোর ক্লাব দোরাদোস দে সিনেলোয়ার একটা ম্যাচের পর। কোচ ম্যারাডোনা সে ম্যাচের পর দুজন মেক্সিকান উপস্থাপককে সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। তাঁদের মধ্যে একজন ম্যারাডোনাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মেক্সিকোতে আসার পর আশা করি আপনি মেক্সিকোর ঘরোয়া ফুটবল নিয়মিত দেখছেন। প্রথম বিভাগের দলগুলোর মান সম্পর্কেও আপনার ভালোই জানার কথা এখন। মেক্সিকোর ফুটবলের মান সম্পর্কে আপনার কী মতামত?’ খুবই সোজাসাপ্টা প্রশ্ন। ম্যারাডোনা চাইলেই গুছিয়ে বলতে পারতেন উত্তরটা। কিন্তু ম্যারাডোনার কাছ থেকে আর গোছানো উত্তর পেলেন কোথায় সাংবাদিকেরা! প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ম্যারাডোনা ‘আ… আ’ করে যতক্ষণ অর্থহীন শব্দ করলেন, উসাইন বোল্ট ততক্ষণে মোটামুটি দুবার এক শ’ মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে আসতে পারতেন! ম্যারাডোনার এই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। প্রচুর হাসাহাসিও হয়েছে এটা নিয়ে।
২০০৯ সালের নিষেধাজ্ঞা
শেষ মুহূর্তে আর্জেন্টিনাকে ২০১০ বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার পর ম্যারাডোনার সেই পাগলাটে স্লাইডটাই মনে আছে সবার। ২০০৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সে ম্যাচে ম্যারাডোনার আরেক কাণ্ডের কথা অনেকেই তাই হয়তো ভুলেও গেছেন। ম্যাচের পরে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অশালীন ভাষায় অপমান করায় ফিফা দুই মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে তাঁকে।
পিতৃত্ব নিয়ে ‘যন্ত্রণা’
নাপোলিতে খেলার সময় ইতালির এক তরুণী ক্রিস্টিনা সিনাগ্রার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। তাঁদের প্রেমের ফসল হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন সিনাগ্রা। সিনাগ্রাও ফুটবল খেলেন, ইতালির অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে অভিষেকও হয়েছিল ম্যারাডোনা–পুত্রের। বহু বছর সিনাগ্রার পিতৃত্ব অস্বীকার করার পর অবশেষে তাঁকে ছেলে হিসেবে মেনে নেন ম্যারাডোনা।
কর সমস্যা
ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়টা ম্যারাডোনা কাটিয়েছেন নাপোলিতে। ইতালির অখ্যাত ক্লাবটিকে বানিয়েছিলেন বিখ্যাত। নাপোলির ঘরে এখন পর্যন্ত যে দুটি স্কুদেত্তো, তা ম্যারাডোনা-জাদুতেই। নাপোলির সেই স্মৃতি সব সময়ই তাঁকে টানে। কিন্তু ২০০৫ সালে ইতালির কর বিভাগ দাবি করে বসে ম্যারাডোনার কাছে তাদের সুদসহ ৩ কোটি ৭২ লাখ ইউরো কর বকেয়া। সম্ভাব্য গ্রেপ্তার এড়াতে তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহুদিন ইতালিতে যাননি ম্যারাডোনা। আট বছর পর ২০১৩ সালে আবারও নেপলসে পা রাখেন এই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনীহা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ম্যারাডোনার বিদ্বেষ নতুন কিছু ছিল না। বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে এসেছেন এই কিংবদন্তি। ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার মার দেল প্লাটায় অনুষ্ঠিত হওয়া ‘সামিট অব দ্য আমেরিকাস’-এ সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এলে প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা করেন ম্যারাডোনা। একটি টি-শার্ট পরেছিলেন, যাতে লেখা ছিল ‘বুশকে থামাও!’ আরেক জায়গায় বুশকে আবর্জনা বলেও উল্লেখ করেন ম্যারাডোনা। শুধু বুশই নন, ম্যারাডোনার রোষানলে পড়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পও। দোরাদোস দে সিনেলোয়ার এক ম্যাচ জয়ের পর আনন্দে উন্মাতাল দলের কোচ ম্যারাডোনা খেলা নিয়ে কোনো কথা না বলে সরাসরি ট্রাম্পকে আক্রমণ করে বসেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দুনিয়ার শেরিফ (প্রধান) মনে করে। সবাইকে বলে বেড়ায়, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা তাদের কাছে আছে। যেকোনো সময় সেই বোমা কোনো জায়গায় ফেলে দিতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, আমাদের সঙ্গে সেটা কিছুতেই হতে দেব না।’