রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে বিধ্বস্ত হেফাজত

কাগজে-কলমে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী। এমনকি হেফাজতে ইসলামকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনাও করছিলেন তারা।

এর অংশ হিসাবে নানা কৌশলে দেশের বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহ করছিলেন কেউ কেউ। সংগঠনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকার উৎখাত করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় লিপ্ত হয় নেতাকর্মীরা।

শুরুর দিকে সংগঠনটির এমন পরিকল্পনা আঁচ করতে পারেনি সরকার। পরিকল্পনার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই হেফাজতের উচ্চাভিলাষী নেতাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে যায়। এই পরিস্থিতিতে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টিও প্রকাশ্যে চলে আসে।

এদিকে শীর্ষ কয়েকজন নেতার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের বিষয়টি জানতে পেরে সংগঠনের অনেকেই প্রকাশ্যেই তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সম্প্রতি কয়েকজন শীর্ষ নেতা পদত্যাগও করেন।

আরও কয়েকজন পদত্যাগ করার প্রস্তুতি নিলে রোববার রাতে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। সব মিলিয়ে বিদায়ি কমিটির কোনো কোনো নেতার নানা অপকর্ম এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে সংগঠনটি এখন অনেকটাই বিধ্বস্ত।

এসব উচ্চাভিলাষীকে বাদ দিয়ে অরাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠনের দাবিও উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও ক্ষমতার মসনদে বসতে সংগঠনের নেতারা একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সংগঠনকে অতিরিক্ত রাজনীতিকী করেছেন। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে বৈঠক করেও সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন।

তাদের উসকানির ফলেই গত ২৬ ও ২৭ মার্চ সারা দেশে সহিংসতায় ১৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন অফিস ও স্থাপনায় হামলা চালিয়ে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে পড়েছে। অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে নাগরিক জীবনে।

এদিকে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে শতাধিক মামলায় প্রায় এক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হেফাজতের মামুনুল হকসহ ১৫ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

রিমান্ডে তারা স্বীকার করেছে, হেফাজতে ইসলামকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই ছিল মূল লক্ষ্য। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় তাণ্ডব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনেও রয়েছে ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

এমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলাম নাগরিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টির একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মইনুদ্দীন রুহী যুগান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলাম যে নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেখান থেকে সরে গিয়েছে।

বিশেষ করে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী নেতা ও কর্মী হেফাজতে ইসলামের কমিটি দখল করে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সংগঠনকে ব্যবহার করছে।

অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাও হেফাজতে ইসলামের কমিটিতে ছিল। এ কারণেই ভুল পথে পরিচালিত হয়ে অরাজনৈতিক সংগঠনটিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হেফাজতের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন আব্দুর রহিম কাসেমী।

তিনি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, মূলত দূরদর্শিতা এবং সমন্বয়হীনতার অভাবেই হেফাজতে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। তা ছাড়া সার্বিক হেফাজতে ইসলাম আর ব্যক্তি বিষয় অন্য।

ব্যক্তিগত হিংসাকে কাজে লাগিয়ে অনেক নেতা উন্মাদনা ছড়িয়েছেন, নানা অপকর্ম করেছেন ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়েছেন। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা সংগঠনের কমিটিতে ছিলেন।

ফলে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন তারা। এ কারণেই সংগঠন এমন সংকটে পড়েছে। এখন আর এ ধরনের নেতাদের সংগঠনে আসতে দেওয়া হবে না।

যারা রাজনীতি করেন তারা আর হেফাজতে থাকবেন না, রাজনৈতিক কোনো ইস্যুতেও হেফাজত জড়াবে না। সংগঠন এখন শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় কাজ করবে।

হেফাজতের একাধিক নেতা জানান, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে হেফাজত ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আল্লামা আহমদ শফী। অথচ সংগঠনের বিলুপ্ত কমিটির শীর্ষ নেতারা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছিল।

এ নিয়ে সংগঠনের একটি অংশ আপত্তি তুলছিল। তারা সংগঠনটিকে ঢেলে সাজানোর পক্ষে ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী হেফাজত নেতারা যত দিন যাচ্ছিল, ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছিল।

তাদের প্রভাবের কারণে অরাজনৈতিক অংশটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। ঢেলে সাজানো হচ্ছে সংগঠনকে।

গ্রেফতার হওয়া হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে যুগান্তরকে জানান, ক্ষমতা দখলের নেশায় হেফাজতের অনেক নেতা উগ্র হয়ে উঠেছিলেন।

এ কারণে তারা হেফাজতের মঞ্চে উঠে নানা উসকানি দিতেন। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে উগ্র বক্তব্য দিতেন। এসব বক্তব্যের উদ্দেশ্যই ছিল ধর্মভীরু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা।

লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং ধর্মভীরু মানুষকে টার্গেট করে বিপুল পরিমাণ অর্থও বিনিয়োগ করে।

জিজ্ঞাসাবাদে হেফাজত নেতারা আরও জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-মাহফিল করতেও একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন উচ্চাভিলাষী নেতারা। তারা একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন।

ওই সংগঠনের অনুমতি না-নিয়ে ওয়াজ-মাহফিলেও অংশ নেওয়া যেত না। এসব ওয়াজ-মাহফিল থেকে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হতো।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ যুগান্তরকে বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে তাণ্ডব থেকে শুরু করে সর্বশেষ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার নেপথ্যে ছিল সরকার উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।

লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে বিদেশ থেকে নানা কৌশলে অর্থ সংগ্রহ করতেন হেফাজতে ইসলামের অন্যতম শীর্ষ নেতা মামুনুল হক। অপকৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে তিনি এই অর্থ ব্যয় করতেন।

মামুনুলের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে ডিসি হারুন-অর-রশিদ বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে তিনি আদর্শিক ভিত্তি হিসাবে পাকিস্তানের একটি সংগঠনকে বেছে নেন।

২০০৫ সালে ভগিনীপতি মুফতি নেয়ামতউল্লাহর সঙ্গে তিনি ৪৫ দিন পাকিস্তানে অবস্থান করে ওই সংগঠনের মডেল সম্পর্কে দীক্ষা নেন।

সেই সংগঠনের আদলে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের নামে যত ধরনের মতাদর্শের মানুষ আছে সবাইকে একই প্ল্যাটফরমে এনে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। সর্বশেষ ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসাবে তিনি হেফাজতে ইসলামকে বেছে নিয়েছিলেন।

এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, হেফাজতের শীর্ষ অনেক নেতার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিষয়ে এরইমধ্যে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। দেশে এবং বিদেশে তাদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *