‘খারাপ আচরণের’ প্রতিশোধ নিতে ব্যাংকে হানা কিশোরের
বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার জন্য ব্যাংকে গিয়েছিল এক কিশোর (১৬)। সেখানে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়া হয়। তাঁদের ‘খারাপ আচরণের’ প্রতিশোধ নিতে সে ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা আঁটে। প্রথমে সে ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরীদের কক্ষে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন মাসের মাথায় ওই ব্যাংকে হানা দিয়ে দুই নিরাপত্তা প্রহরীর ওপর রাসায়নিক নিক্ষেপ করে। এরপর একজনকে ছুরিকাঘাত করে কৌশলে পালিয়ে যায়।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সাবেকপাড়া বাজারের রূপালী ব্যাংকের শাখায় ‘ডাকাতিচেষ্টার’ মামলায় এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। বগুড়া শহরের একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এসএসসি পরীক্ষার্থী ওই কিশোর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই তথ্য দিয়েছে।
পুলিশ বলছে, খারাপ ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে ‘রোমাঞ্চ’ থেকে ওই কিশোর ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা করে। এরপর একটা চাকু, ব্যাগ আর নাইট্রোজেন জেল, অ্যাসিটোনাল অ্যালকাইনের মতো কিছু রাসায়নিক পদার্থ জোগাড় করে বেরিয়ে পড়ে ব্যাংক লুটের মিশনে। তবে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ওই কিশোর নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে বিতণ্ডার জেরে রাতে তালা কেটে ব্যাংকে প্রবেশের কথা স্বীকার করলেও ডাকাতি, লুট বা চুরির কথা বলেননি।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই কিশোর জানিয়েছে, সে আইটিতে দক্ষ এবং হ্যাকার গ্রুপের একজন সদস্য। ভারতীয় ‘ধুম’ চলচ্চিত্রটি দেখে তার মাথায় ব্যাংক লুটের ‘রোমাঞ্চকর’ পরিকল্পনা আসে।
গত শুক্রবার বগুড়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসমা মাহমুদের আদালতে গ্রেপ্তার কিশোর তার ‘রোমাঞ্চ’ মিশনের ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও গাবতলী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন নিশ্চিত করেছেন। ওই কিশোরের বাবা সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটশেরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তবে এখন বগুড়া শহরে বসবাস করেন।
পুলিশ দাবি করেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই কিশোর জানিয়েছে, সে আইটিতে দক্ষ এবং হ্যাকার গ্রুপের একজন সদস্য। ভারতীয় ‘ধুম’ চলচ্চিত্রটি দেখে তার মাথায় ব্যাংক লুটের ‘রোমাঞ্চকর’ পরিকল্পনা আসে। তবে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে ওই কিশোর এসব স্বীকার করেনি।
তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে যা পেয়েছে পুলিশ
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ৪ জানুয়ারি রূপালী ব্যাংকের সাবেকপাড়া শাখায় দুর্বৃত্তের হানা দেওয়ার ঘটনার পরদিন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপক বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় সিসিটিভির ফুটেজের ভিত্তিতে পিপিই ও মুখোশ পরা একাধিক আসামির কথা উল্লেখ করা হলেও পরে তদন্তে ধরা পড়ে অপরাধী একজনই। সে কোনো পিপিই পরা ছিল না। এরপর ওই একজনকে ধরতে ঘটনার দিনে ব্যাংক এলাকার টাওয়ারে ব্যবহৃত প্রায় ২০০ জনের মুঠোফোন নম্বর তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে একটি নম্বর ঘটনার সময় থেকে সকাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল।
ওই মুঠোফোনের সূত্র ধরে প্রথমে গ্রেপ্তার কিশোরের বগুড়া শহরের এক সহপাঠীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে ওই ফোন ব্যবহারকারীর নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। এরপর গত শুক্রবার গাজীপুরের টঙ্গী থেকে ওই কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ‘ব্যাংক লুটচেষ্টার’ কাহিনির বর্ণনা দেয়। লুটের উদ্দেশ্যে ব্যাগ, চাকু আর রাসায়নিক কিছু পদার্থ নিয়ে ওই কিশোর একাই ব্যাংকটিতে ‘দুঃসাহসিক রোমাঞ্চ’ অভিযানে নামে। এ ঘটনায় তার সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। অভিযানে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন জেল ও অ্যাসিটোনাল অ্যালকাইন সে নিজেই তৈরি করে।
ওই কিশোরের সাইবার অপরাধীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সে আন্তর্জাতিক একটি হ্যাকার দলেরও সদস্য। হ্যাকিংসহ সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে সে তার মায়ের ট্রাস্ট ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরের কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও তথ্য দিয়েছে।
পরে ওই কিশোর পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে সে উল্লেখ করেছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা থেকে ব্যাংকের ছাদে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। পরে প্রধান ফটকের তালা কেটে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে একজন আনসার সদস্যের চোখে নাইট্রোজেন জেল ছুড়ে মারে। অন্যজনকে ঘায়েল করতে ছোড়া হয় অ্যাসেটোনাল অ্যালকাইন। এরপর দুজনকে বাঁধতে গিয়ে ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় একজন গার্ড তাকে ছুরিকাহত করলে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে আসে। প্রথমে বগুড়া শহরে এক বন্ধুর বাসায় থেকে ছদ্মনামে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়। তিন দিন পর টঙ্গীতে চাচার বাসায় আত্মগোপন করে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা দাবি করেন, ওই কিশোরের সাইবার অপরাধীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সে আন্তর্জাতিক একটি হ্যাকার দলেরও সদস্য। হ্যাকিংসহ সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে সে তার মায়ের ট্রাস্ট ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরের কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও তথ্য দিয়েছে।
আদালতে জবানবন্দিতে যা বলেছে কিশোর
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির একটি অনুলিপি পেয়েছে প্রথম আলো। সেখানে কিশোর উল্লেখ করেছে, গাবতলীতে তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের বিল দিতে রূপালী ব্যাংকের সাবেকপাড়া শাখায় যায়। এ সময় ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী তার সঙ্গে ‘খারাপ আচরণ’ করেন। সেই ঘটনার শোধ নিতে প্রথমে ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী যে কক্ষে থাকতেন তার পাশের ঘরে জানালা দিয়ে আগুন দেয়।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে ওই কিশোর উল্লেখ করেছে, আগুন দেওয়ার পর তার কিছুই না হওয়ায় সাহস বেড়ে যায়। ৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মুঠোফোন বন্ধ করে ব্যাংকের ছাদে ওঠে। সেখানে অপেক্ষা করতে থাকে। রাত তিনটায় ব্যাংকের ফটকের তালা কেটে ফেলে। সেখানে গিয়ে সে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না, তা নিয়ে ধন্দে পড়ে যায়। ভোর ৫টা ৩৭ মিনিটে নিচের ফটকের তালা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে একজন নিরাপত্তাকর্মীর চোখে নাইট্রোজেন জেল ঢেলে দেয়। এরপর মেঝে পিচ্ছিল করতে অ্যাসিটোনাল অ্যালকাইন ঢেলে দেয়। একজন নিরাপত্তাকর্মীকে কান ধরে ওঠবস করায়। আরেকজনের হাত বাঁধতে গেলে অন্যজন পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় সে অপর নিরাপত্তাকর্মীকে ধরে মেঝেতে শুইয়ে রাখে। অন্যজনের হাত বাঁধার সময় একজন দৌড়ে গিয়ে ব্যাংকের ফটক লাগিয়ে দেন। হাত বাঁধার সময় চাকু মেঝেতে রেখে দিলে অন্যজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় এক নিরাপত্তাকর্মী মেঝেতে রাখা চাকু দিয়ে তার পেটে আঘাত করে। এরপর চাকু কেড়ে নিয়ে একজনকে আঘাত করে ব্যাংকের ছাদ দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে আসে সে।বিজ্ঞাপন
ছেলেকে নির্দোষ দাবি বাবার
যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকের ওই রাতের নিরাপত্তাকর্মী আনসার সদস্য হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দুই মাস আগে তিনি সাবেকপাড়ার রূপালী ব্যাংকের শাখায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগ দেন। বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো বিবাদ হয়নি তাঁর।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁকে থানায় ডেকেছিলেন। তাঁর ছেলে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করতে পারে এটা বিশ্বাস হয়নি।
একই কথা বলেন আরেক আনসার সদস্য মাসুদ রানা। মাসুদ বলেন, আততায়ীর সংখ্যা কতজন ছিল, সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। তবে ধস্তাধস্তি হয়েছে একজনের সঙ্গে। বয়সে কিশোর কি না, ওই সময় বোঝা যায়নি।
এ ঘটনা নিয়ে ওই কিশোরের বাবার সঙ্গে রোববার মুঠোফোনে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি একমাত্র ছেলেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, বগুড়ার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সে। সেরা স্কাউটার। বিএনসিসিও করত। বিজ্ঞানের নানা বিষয় উদ্ভাবন আরও করেছে। পড়াশোনা ছাড়া আর উদ্ভাবন ছাড়া সে কিছুই বোঝে না।
৪ জানুয়ারি রাতে তাঁর ছেলে কোথায় ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে সন্ধ্যার আগে বাসা থেকে বের হয়। তিন দিন পর টঙ্গীতে চাচার বাসায় যায়। মাঝখানে দুদিন ঢাকায় ছিল বলে জানায়। বাবা আরও বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁকে থানায় ডেকেছিলেন। তাঁর ছেলে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করতে পারে এটা বিশ্বাস হয়নি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে ব্যাংক লুটের কথা জানিয়েছিল ওই কিশোর। এ জন্য সে সঙ্গে একটি ব্যাগও নিয়েছিল। কিন্তু আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ব্যাংকে অ্যাডভেঞ্চার অভিযানে শুধু একটি চাকু এবং কিছু রাসায়নিক পদার্থ সঙ্গে নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। আদালতে দেওয়া জবানবন্দির তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। গরমিল পাওয়া গেলে তদন্তে সত্য বেড়িয়ে আসবে।
বগুড়া কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মনির আহমেদ বলেন, আদালতের নির্দেশে ওই কিশোরকে যশোর কিশোর শোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।