মামুনুল হককে ডিবিতে হস্তান্তর

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরবিরোধী কর্মসূচিকে ঘিরে বিক্ষোভ-সহিংসতার সময় আলোচিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এই নেতাকে মোহাম্মদপুর থানার একটি মারধরের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

এ ছাড়া মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় অন্তত ১৭টি এবং নারায়ণগঞ্জে ১টি মামলা রয়েছে। রোববার বেলা একটায় মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় শ্যামলীতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের কার্যালয়ে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেখান থেকে বেলা দুইটায় নেওয়া হয় তেজগাঁও থানায়।

তেজগাঁও থানায় কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর রাতে মামুনুল হককে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামুনুল হক এখন ডিবি হেফাজতে আছেন। আগামীকাল তাঁকে আদালতে পাঠানো হবে।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ও সহিংসতার পর বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। এর মধ্যে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর এই সফরের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন। এ নিয়ে গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজের পর তাঁদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এর জের ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতায় অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের পর হওয়া ১৫টি মামলার আসামি মামুনুল হক।

এই ঘটনার রেশ যেতে না যেতেই ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার একটি রিসোর্টে এক নারীসহ ঘেরাও করা হয় মামুনুল হককে। একপর্যায়ে রিসোর্টে হামলা চালিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে নেন হেফাজতের কর্মীরা। সেখানে ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় তিনটি মামলা হয়। একটি মামলায় আসামি করা হয় মামুনুল হককে।

রিসোর্টে যে নারীসহ মামুনুল হক ঘেরাও হন, সে নারীকে তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। এর কিছুদিন পরই গাজীপুরের এক নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়। সেই নারীর ভাই নিজের বোনকে খুঁজে পাচ্ছেন না জানিয়ে মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছিলেন।

রোববার দুপুরের পর মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালে মোহাম্মদপুরে একটি ভাঙচুরের মামলায় মামুনুল হককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা আছে মতিঝিল, পল্টন ও নারায়ণগঞ্জে। পরে সেসব সমন্বয় করা হবে।

তেজগাঁও পুলিশের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, ২০২০ সালের ৭ মার্চ মোহাম্মদপুর থানায় হওয়া মামলায় মামুনুল হক সাত নম্বর আসামি। মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণীতে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানা অজ্ঞাত লেখা আছে। মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিংয়ের বাসিন্দা জি এম আলমগীর শাহীন বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সংঘর্ষ হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সংঘর্ষ হয়।

আলমগীর শাহীন আসামিদের বিরুদ্ধে এলোপাতাড়ি মারধর, হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করে গুরুতর জখম, চুরি, হুমকি দেওয়া, ধর্মীয় কাজে ইচ্ছাকৃতভাবে গোলযোগ সৃষ্টি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ করেন। সে সময় একটি মুঠোফোন, ৭ হাজার টাকা, ২০০ ডলার এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ডেবিট কার্ড চুরি হওয়ার কথাও মামলায় উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

এর বাইরে মামুনুলের বিরুদ্ধে কেবল রাজধানীতেই অন্তত ১৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলার মধ্যে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের পর হওয়া ১৫টি মামলায় তাঁর নাম রয়েছে।বিজ্ঞাপন

ডিএমপি সদর দপ্তরের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, ডিবির মতিঝিল বিভাগে তদন্তাধীন আটটি মামলা, লালবাগ বিভাগের দুটি মামলা এবং তেজগাঁও বিভাগেরে একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মামুনুল হক। এ ছাড়া মতিঝিল থানার একটি এবং পল্টন থানার চারটি মামলায় তাঁর নাম রয়েছে। ১৬টি মামলার মধ্যে ১৫টি মামলাই হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের পর।

মামুনুল হকের বিরুদ্ধে সর্বশেষ মামলা হয়েছে ৫ এপ্রিল। গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় এই মামলা করেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) উপদপ্তর সম্পাদক খন্দকার আরিফ উজ জামান। মামুনুল হক এই মামলার এক নম্বর আসামি।

মামলার এজাহারে খন্দকার আরিফ উজ জামান বলেছেন, জুমার নামাজ শেষে তিনি কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ধর্মান্ধ ব্যক্তিকে মসজিদের ভেতর জুতা প্রদর্শন করতে দেখেন। এরপর মসজিদ থেকে বের হয়ে উত্তর গেটের সিঁড়িতে জামায়াত-শিবির-বিএনপি-হেফাজতের কয়েক হাজার উগ্র মৌলবাদী ব্যক্তির উচ্ছৃঙ্খল জমায়েত দেখেন।

তাঁদের স্লোগান ও কথাবার্তা থেকে জানতে পারেন, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় জামায়াত-শিবির-বিএনপি-হেফাজতের নেতারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে দেশি-বিদেশি সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মসূচি বানচাল করার ও ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করেন। এই জমায়েত থেকে জঙ্গিরা রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। মামুনুল হকের নির্দেশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ দা, ছোরা, কুড়াল, কিরিজ, হাতুড়ি, তলোয়ার, বাঁশ, গজারি লাঠি, শাবল ও রিভলবার, পাইপগানসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সাধারণ মুসল্লিদের ওপর হামলা করেন তাঁরা।

গত বছর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা মারধর ও চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে মামুনুল হককে।

খন্দকার আরিফ উজ জামান মামলায় বলেছেন, মামুনুল হকের হুকুমে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব লোহার রড দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যেই অতর্কিতে তাঁর মাথায় বাড়ি মারেন। প্রাণ বাঁচাতে তিনি মাথা সরিয়ে নিলে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচে বড় রড দিয়ে বাড়ি মেরে গুরুতর জখম (হাড় ভাঙা) করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *