ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যা, জঙ্গি জিয়াকে নিয়ে যত ভয়

আট বছর আগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় এই দিনে মিরপুরে ব্লগার রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরবর্তী তিন বছরে জঙ্গিদের হাতে নিহত হন আরও আটজন ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, অধিকারকর্মী ও নাট্যকর্মী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গিদের তৎপরতা এখন নিয়ন্ত্রণে। তবে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর মূল পরিকল্পনাকারী চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আতঙ্ক দূর হবে না বলে মনে করেন নিহতের পরিবারের সদস্য, মুক্তমনারা।

পুলিশ তদন্ত করে আদালতকে যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, ৯টি হত্যাকাণ্ডের আটটিতেই জড়িত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। ছয়টি খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের রায়েও আদালত বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হলেন চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া।

৯ জনের খুনের ঘটনায় হওয়া আটটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালতে দুটি হত্যাকাণ্ডের রায় হয়েছে। রায়ে ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকি খুনের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে আদালতে। এর মধ্যে চারটি খুনের মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। দুটি খুনের মামলা বিচার শুরুর অপেক্ষায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীর্ষ জঙ্গিনেতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকে গ্রেপ্তারের জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা জানি, জঙ্গিনেতা জিয়া একজন ভয়ংকর অপরাধী। তাঁকে ধরার জন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে।

যাঁরা খুন হয়েছিলেন

ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়। এর ৩৪ দিনের মাথায় ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান। ৪২ দিন পর ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেটে নিজ বাসার সামনে জঙ্গিদের হাতে খুন হন আরেক ব্লগার অনন্ত দাস।

এরপরের খুনটি হয় ৮৬ দিনের মাথায়। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার ভাড়া বাসায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন আরেক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে জঙ্গিদের হাতে খুন হন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। একই দিন একই জঙ্গি সংগঠনের অপর সদস্যরা শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে কুপিয়ে জখম করেন। ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল সূত্রাপুরে রাস্তায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার নাজিম উদ্দিন। এর ১৯ দিন পর ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী। ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ সমকামীদের অধিকারবিষয়ক সাময়িকী রূপবান সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর মাহবুব একজন নাট্যকর্মী।

খুনের তদন্ত ও বিচার

ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার বিচারিক আদালত দুই জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড আর ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। হাইকোর্টেও বিচারিক আদালতের রায় বহাল আছে।

রাজীব হায়দারের বাবা চিকিৎসক নাজিম উদ্দিন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, রায়ে মাত্র দুজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তবে এই রায়ে তিনি সন্তুষ্ট নন।

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের রায় দেন। রায়ে জঙ্গি জিয়াসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১৬ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল।

সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে। এ মামলায় চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াসহ অভিযুক্ত আসামির সংখ্যা ৮।

সরকারি কৌঁসুলি গোলাম ছারোয়ার খান প্রথম আলোকে বলেন, এই জোড়া খুনের মামলার বিচারও শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান হত্যা মামলাটি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এই হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত আসামি পাঁচজন।

ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যা মামলাটি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এ মামলায় ১৩ জঙ্গিনেতাকে আসামি করা হয়েছে।

ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এ মামলায় আসামি ছয়জন। ব্লগার নাজিম উদ্দিন হত্যা মামলায়ও পুলিশ চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। মামলাটির বিচার এখনো শুরু হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *