দুর্যোগ বেড়েছে, কমেছে ক্ষতি
দেশে আগের চেয়ে বেশি হারে দুর্যোগ আঘাত হানছে। তবে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির হার কমেছে। দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় কিছুটা উন্নতিও হয়েছে বাংলাদেশের।
সরকারি সংস্থা জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) ১৫৮২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে আঘাত হানা ঝড়গুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ১৫৮২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে ৬১টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এর মানে হলো, এ সময়ে প্রতি ৬ বছর ৪ মাসে একটি করে বড় ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আঘাত হানে ২৭টি ঘূর্ণিঝড়। অর্থাৎ, এ সময়ে প্রতি ১ বছর ১০ মাসে একটি করে ঝড় আঘাত হেনেছে।
বাংলাদেশ দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর দিক দিয়ে যে সাফল্য পেয়েছে, তা উঠে এসেছে বিশ্বের জলবায়ু ও দুর্যোগ পর্যবেক্ষণকারী গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক প্রতিবেদনে (২০২১)। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়প্রবণ দেশ। তবে দেশটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, পূর্বাভাস ও যোগাযোগের উন্নতি, বনায়ন এবং ঝড়ের আগে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে উপকূলবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে পেরেছে।
প্রতিবেদনে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ওই ঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে আরেক ভয়ংকর ঝড় সিডরে মারা যান ৪ হাজার ২৩৪ জন। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে দেশে ২৬ জন মারা যান।
জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০২১ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের হিসাব বিবেচনায় জলবায়ু ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। তবে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে মৃত্যুহারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ২৯তম। আর্থিক ক্ষতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ ২০তম অবস্থান পেয়েছে।
একই সূচকে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। বলা হয়, এ সময়ে দুর্যোগঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম। বছরে গড়ে মারা গেছেন ৫৭২ জনের মতো। আর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বছরে গড়ে ১৮৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমান। এ সময়ে ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ১০ দেশ হলো পুয়ের্তে রিকো, মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামাস, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও নেপাল।
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) চলতি মাসে একটি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, ১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি নামে একটি কার্যক্রম শুরু করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রসের সহায়তায় উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম পূর্বাভাস ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। উপকূলবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করে তাঁদের প্রশিক্ষণ ও উদ্ধারসামগ্রী দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বন্যা মোকাবিলায় ৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। প্রায় ২ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং ২০০ বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এসব অবকাঠামো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়ে গেছে।
দুর্যোগের ক্ষতি কমাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই ভালো বলে উল্লেখ করেন ইউএনডিপি, বাংলাদেশের দুর্যোগবিষয়ক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আরিফ আবদুল্লাহ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলার কার্যক্রম হিসেবে বিশ্বজুড়ে একসময় শুধু ত্রাণসহায়তা দেওয়া হতো। এরপর আসে ঝুঁকি কমানোর বিষয়টি। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, দুর্যোগের পরে মানুষকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে ভূমিকম্প নিয়ে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটে রিখটার স্কেলে একটি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কমপক্ষে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ভবন ও অবকাঠামো ভেঙে পড়বে। মারা যাবেন কয়েক লাখ মানুষ। এতগুলো ভবন ভেঙে গেলে সেগুলো থেকে নাগরিকদের উদ্ধার করা এবং ভাঙা অংশ সরানোর মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
আসলে প্রস্তুতি কী, তা জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকার ভূমিকম্প মোকাবিলায় ৩৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেছি। তাঁদের এখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আর ভূমিকম্পের পর দুর্গত মানুষদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে দুটি স্থানকে প্রস্তুত করা হবে।’
আজ বুধবার জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে দিবসটি পালন করছে সরকার। তবে এবার দিবসটি পরে পালন করা হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা বাংলাদেশকে বড় শিক্ষা দিয়েছিল। এরপর ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ভূমিকম্প হলে আমরা কীভাবে মানুষকে উদ্ধার করে তাঁদের জীবন বাঁচাব, তার জন্য বড় ধরনের উদ্যোগ দরকার। বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে।’