ভূমি অফিসে আইপি ক্যামেরা ও সেন্সরযুক্ত লকার স্থাপনের সিদ্ধান্ত

অনিয়ম, দুর্নীতি ও জনহয়রানি রোধে দেশের প্রতিটি এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার, ভূমি) অফিসে আইপি ক্যামেরা স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি নথিপত্র সুরক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হবে সেন্সরযুক্ত বিশেষ লকার। সম্প্রতি ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিভাগীয় কমিশনারদের সভায় বিস্তারিত আলোচনা করেন। আইপি ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ভূমি অফিসগুলোর সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করা হবে। প্রয়োজনে মন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রণালয় ও মাঠপ্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি আইপি ক্যামেরায় যুক্ত হয়ে সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন। কীভাবে, কতদিনের মধ্যে দেশের পাঁচ শতাধিক এসি ল্যান্ড অফিসে এ ক্যামেরা স্থাপন করা যায়, এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় কার্যকর ত্বরিত পদক্ষেপ নিচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এসি ল্যান্ড অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতি ও জনহয়রানি রোধে এ পর্যন্ত নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও কার্যত তেমন কোনো সুফল বয়ে আনেনি। মন্ত্রণালয় কোনো ভালো পদক্ষেপ নিলে ভূমি অফিসের দালাল ও দুর্নীতিবাজ চক্র বিকল্প পথ বের করে ফেলে। এজন্য এখন আইপি ক্যামেরা স্থাপন করে লাইভ মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ভূমিমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনারদের সভায় ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিস্তারিত আলোচনা করেন। বিভাগীয় কমিশনাররা আইপি ক্যামেরা স্থাপনে তাদের জোরালো অভিমত দেন। এছাড়া সভায় একজন বিভাগীয় কমিশনার জানান, অনলাইনে আবেদন করেও জনগণ ই-নামজারির সুফল সেভাবে পাচ্ছে না। কারণ এ সংক্রান্ত কোর্ট ফি দেওয়ার জন্য আবেদনকারীকে সশরীরে ভূমি অফিসে যেতে হচ্ছে। এ সময় সচিব অনলাইনে কোর্ট ফি নেওয়ার নির্দেশনা দেন। এদিকে আইপি ক্যামেরা প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রোববার যুগান্তরকে বলেন, এ ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্স করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক ভিডিও ছাড়াও অডিও রেকর্ড হয়ে থাকে, যা মেমরি কার্ডে সংরক্ষণ করা যায়। ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্মকর্তা চাইলে যে কোনো সময় অনলাইনে সংশ্লিষ্ট অ্যাপে প্রবেশ করে গোপনেও ভূমি অফিসের সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করতে পারবেন। ছবি ছাড়াও অডিও শোনা যাবে। প্রয়োজনে অপ্রীতিকর কোনো মুহূর্তের ছবিও গোপনে তুলে রাখা যাবে। কিংবা হঠাৎ করে সরাসরি কথাও বলতে পারবেন। এছাড়া আইপি ক্যামেরার আরেকটি ভালো দিক হলো, এই ক্যামেরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে পরিচালনা করা যায়। অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ফোনেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঘটনাস্থলের চতুর্দিক মনিটরিং করা খুবই সহজ। এর দামও বেশি না। একসঙ্গে বহু ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

সভায় তহশিল ও এসি ল্যান্ড অফিসের রেকর্ডপত্র যাতে চুরি কিংবা গায়েব না হয়ে যায়, সেজন্য বিশেষ সেন্সরযুক্ত আধুনিক লকার কেনার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে ভূমি সচিব দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, এ ধরনের ডিজিটাল লকারে কেউ হাত দিলেই এসি ল্যান্ডের মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। ফলে এ ধরনের লকার স্থাপন করা হলে ভূমি অফিসগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র গায়েব কিংবা ঘষামাজা হওয়ার আশঙ্কা আর থাকবে না। সংগত কারণে সভা থেকে ডিজিটাল লকার কেনার বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়।

প্রসঙ্গত, মাঠপ্রশাসনে ভূমি অফিসগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকে নানাভাবে জনহয়রানির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এর আগের মেয়াদে যখন এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তখন শুরু থেকেই তিনি ভূমি অফিসের জনহয়রানি রোধে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসি ল্যান্ড অফিসে তিনি আকস্মিক পরিদর্শন করেন। হাতেনাতে বহু অনিয়ম, দুর্নীতি ও জনহয়রানির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নেন। এজন্য তিনি বেশ প্রশংসিত হন। এরপর তিনি এসব হয়রানি কমিয়ে আনতে ভূমি অফিসগুলোর সেবা কার্যক্রম অনলাইনে চালু করার ওপর জোর দেন। পাইলট প্রকল্প হিসাবে বেশ কয়েকটি এসি ল্যান্ড অফিস শতভাগ ডিজিটাল সিস্টেমে আনা হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছুদিন থেকে অনলাইনে নামজারি কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বর্তমান ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান নিজেই আইটি বিষয়ে একজন পারদর্শী ব্যক্তি। তিনি চাকরিজীবনে একসময় প্রোগ্রামার হিসাবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে ৩ বছর কর্মরত ছিলেন। ২০১১ সালে যশোরে ডিসি থাকাবস্থায় জেলাকে ডিজিটাল জেলা হিসাবে ঘোষণা করেন এবং ই-এশিয়া পদক লাভ করেন। এছাড়া ই-সেবা বাস্তবায়নে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি ২০১২ সালে শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসকের পুরস্কার পান। জনসেবায় অনন্য ভূমিকা রাখায় ভূমি সচিব ২০১৬ সালে জনপ্রশাসন পদকও অর্জন করেন। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার থাকাবস্থায় তিনি মাঠপ্রশাসনে ই-ফাইল চালু করার বিষয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে সত্যিকারার্থে কার্যকর ডিজিটাল ভূমিপ্রশাসন গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে এখন তিনি রোডম্যাপ প্রস্তুতির কাজ করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *