বিলপারের কৃষক, কিশোরী আর পানকৌড়ি
মাটিতে উবু হয়ে বসে যে মানুষটা একমনে কাজ করে যান, তাঁকে আমরা কৃষক বলি। সড়ক দিয়ে যেতে যেতে দূর থেকে তাঁদের দেখা হয়। শহরের মানুষের তাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার অবসর কিংবা সুযোগই–বা কই। তবু মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যায়।
ঢাকার বছিলার শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু পেরিয়ে কলাতিয়া বাজারের দিকে যাচ্ছি। আগে বছিলা পেরোলেই কৃষিজমি ও জলাশয় দেখা যেত, এখন দেখা যায় বালু ভরাট করা খণ্ড খণ্ড প্লট। বছরের পর বছর পড়ে থাকা এসব জমিতে এখনো না হয়েছে ঘরবাড়ি, না হতে পারছে কৃষিকাজ। কলাতিয়া সড়ক ধরে গেলে দুপাশে কিছু খেতখামার চোখে পড়ে। তবে কলাতিয়া বাজার পেরোলে তবেই দেখা পাওয়া যায় নিখাদ গ্রাম। সেদিকেই চলছিলাম। হঠাৎ সাইরেন শুনে গাড়ির আয়নায় দেখি পুলিশের গাড়ি। খবরের সন্ধানে পিছু নিলাম। সাধারণত পুলিশ ধাওয়া করে অপরাধীদের। এ–যাত্রায় সাংবাদিক ছুটছেন পুলিশের পেছনে। আঁকাবাঁকা পথে ছুটতে ছুটতে একসময় দেখি পুলিশের গাড়িটি হাওয়া, আর আমরা এসে পড়েছি এক বিলের পাশে।
পথের দুদিকেই সবজির খেত। জায়গাটার নাম সিরাজনগর। রাস্তার ডান পাশে বিরাট বিল। শীতের কারণে পানি নেমে গেছে মাঝের গভীর জায়গাটায়। সেই জলরাশির চতুর্দিকে জেগে ওঠা জমিতে শর্ষে, ফুলকপি, পাতাকপি, ডাঁটাশাক, লালশাক, মরিচ—এসবের আবাদ। পুলিশের পিছু ছুটে খবরের খোঁজ না পেলে কী হবে, বাংলার এক আদি কৃষকের দেখা পেলাম!
এই যে সুন্দর গ্রাম, সরল কৃষক পরিবার, তার পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর এই বিপদ। হাসপাতালটির ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক্যানসার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট: ২০১৫-১৭’ প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, ক্যানসার শনাক্তকৃতদের মধ্যে কৃষকের হারও এখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।
শুকাতে দেওয়া সাদা শাড়ির মতো কুয়াশার মেঘ বিলের ওপর ভেসে আছে। একঝাঁক কালো পানকৌড়ি উড়ে গিয়ে বসছে কচুরিতে। তাদের হইচইয়ে বিরক্ত কতিপয় বক উড়ে যাচ্ছে বিলের পূর্ব দিকে অন্ধকার হয়ে থাকা বাঁশঝাড়ের দিকে। রোদ নেই, মেঘলা আকাশের নিচে কুয়াশা মোড়ানো শীতলতা। সবুজ-হলুদ-লাল সবজিগুলো সতেজ মুখ করে তাকিয়ে আছে। লাউয়ের মাচার নিচে আলসেমিতে মত্ত দুটি বিড়াল। কৃষকের বাড়ির লেবুগাছের ঝোপের ডালে পরপর বসা তিনটি মুরগি যেন বিজ্ঞ মাথার ঝুঁটি এদিক–ওদিক নাড়িয়ে সতর্ক চোখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ভাবটা এমন, বেমিল দেখলেই ভাবগাম্ভীর্য ঝেড়ে দৌড় দেবে বাড়ির ভেতরে। একটি কিশোরী চারটি অবাধ্য ছাগলের পেছনে ছুটছে আর বকা দিচ্ছে, ‘একদম কথা শোনছ না তরা’।বিজ্ঞাপন
পরে জানা গেল, এ হলো জয়নালের মেয়ে শাহনাজ। তার বড় যে ভাই, সে বিদেশে কাজ করে। আর ওই যে বিলের ধারের রাস্তা ধরে কাঁচি-টুকরি হাতে দুটি শিশু আসছে, তারা চতুর্থ শ্রেণির সুমাইয়া আর শিশু শ্রেণির আরমিনা। তারা দাদা জয়নালের সঙ্গে জমিতে যাচ্ছে ফুলকপি তুলতে। বড় বোন সুমাইয়ার দুঃখ, ক্লাসে মুখস্থ বলতে পারেনি বলে আরমিনাকে প্রথম শ্রেণি থেকে নামিয়ে শিশু শ্রেণি দেওয়া হয়েছে। ওদের দাদা পৌঢ় কৃষক জয়নালের মুখে সব সময়ই হাসি। নিজের খেত থেকে বাঁধাকপি, ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, দুই রকমের লাউশাক তুলে দিয়ে মনটা ভরিয়ে দিলেন। শীতের তাজা সবজির স্পর্শে মনে হলো, এ তো শুধু খাদ্য না, এই-ই তো জীবনীশক্তি। ঢাকার বাজারের মূল্যে দাম দিতে গেলে অবাক হলেন। এতটা তিনি আশা করেননি।
জয়নালের মেয়েটি অবশেষে ছাগলগুলোকে খুঁটার সঙ্গে বাঁধতে পেরেছে। ওদের মা লাউয়ের মাচার তলে ঢুকে বেছে বেছে কচি লাউ তুলে দিলেন। বিল থেকে আবার ভিটায় উঠতে উঠতে বললেন, ‘হাতে কাজ পইড়া রইছে, আমি যাইগা।’ গোয়ালে পাঁচটা তাগড়া গরু, দুটি বাছুর। গোয়ালের পেছনে গোবর আর কচুরিপানা মেশানো জৈব সারের স্তূপ। তার পাশের বেলগাছে একটা সুন্দরী মাছরাঙা উৎসাহী চোখে বিলের দিতে তাকিয়ে আছে।
ইলিয়াসের খোয়াবনামা
জয়নালের খেত পেরিয়ে বিলের জলরাশির দিকে আগালে পাশাপাশি দুটি খেত। একটিতে তিন ভাইবোন আর বাবা-মা মিলে নীরবে লালশাক তুলে চলেছে। খুবই নীরব পরিবার। পাশের জমির লোকটিকে দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। আইল ধরে এগোলে কানে আসে বিড়বিড় করে বলা তাঁর কথা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসের তমিজের বাপও এমন আনমনে কথা বলত। তিনিও কাৎলাহা বিলের সিথানে জাগা নতুন মাটির কৃষক।
ফসলের রোগবালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের জন্য কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, পতঙ্গনাশক ও রোডেন্টিসাইড (ইঁদুর মারা বিষ) ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবছর এসব কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে গড়ে ৩৫-৩৭ হাজার টন। এ ছাড়া বছরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার হচ্ছে ৫০ লাখ টনের বেশি। কৃষকের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি এসব উপকরণের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সার্বিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশেও দেখা যাচ্ছে বিরূপ প্রভাব।
আমাদের ইনি অবশ্য তমিজ নন, জমিরের বাপ। সবুজ ধনেখেতে তিনি ফুটে ছিলেন লাল পাঞ্জাবি আর মাওলানা ভাসানীর মতো সফেদ দাড়িতে। আবারও মনে হলো, যেভাবে মহাত্মা গান্ধী নিয়েছিলেন গুজরাতি কৃষকের দরিদ্র বেশ, ঠিক সেভাবেই মওলানা ভাসানীর বেশভূষার মধ্যে ফুটে ওঠে বাংলার মুসলিম কৃষকের মাসুম চেহারা। উনিশ শতকের শেষের দিকে ছাপা পুঁথিতে আদি মানবকে কৃষক হিসেবে ভাবা হয়েছিল। তাই লেখা হয়: আদম করে কৃষিকাজ/ হাওয়া বোনে তাঁত।
এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠলেন প্রবীণ মানুষটি। ‘আপনারা আইলে বড় খুশ লাগে, ছবি তুলবেন?’
অনেক কথা হলো। মানুষটার নাম লিয়াকত আলী, বয়স সত্তরের ওপরে। অনেক বছর আগে যখন এই এলাকা বুড়িগঙ্গা নদীর আশ্রয়ে ছিল, তখন বড় চর জেগে উঠলে কুমিল্লা থেকে অনেক মানুষ এসে সেই চরে বসত বাঁধেন। তিনি যে জমি চাষ করছেন, একসময় সেটা তাঁর দাদায় করত। দাদা ছিলেন মাতবর গোছের মানুষ। দাদার পরে জমির হাল এখন তাঁর হাতে। কিন্তু তাঁর তিন ছেলের কেউ কৃষিকাজে মন দেবে কি না, তা বলা যায় না। তারা কেউ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কেউ গাড়ি চালানো শিখছে, আরেকজন টুকটাক এটা–ওটা করে। এই গ্রামে বিদ্যুতের মিস্ত্রির দরকার পড়ে কম। ড্রাইভার ছেলের লাইসেন্স এখনো মেলেনি। ফলে কারোরই আয়-উপার্জন ভালো নয়। অথচ কী আদরে বাড়িতে ধরে নিয়ে আপ্যায়ন করলেন, সম্পর্ক পাতালেন।
কৃষির সঙ্গে বিরোধের পাঁচিল
কৃষিতে তাঁরা আসবেনই–বা কেন? তাঁদের জমির কপি রায়েরবাজারে কিংবা কারওয়ান বাজারের আড়তে ৫ থেকে ১০-১২ টাকার বেশি দাম পায় না। যে ধনেপাতার আঁটি বাঁধছেন, প্রতিটিতে পাবেন দুই টাকা। অথচ এই কপি ঢাকার বাজারে ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়, ধনেপাতার আঁটি চলে ১০ টাকা করে। ফিরবার পথে তা-ই দেখা গেল। লিয়াকত আলীর জমি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের কলাতিয়া বাজারে একটি মাঝারি মাপের কপির দাম ২৫ টাকা। আর কারওয়ান বাজারে তার দাম ৩০-৩৫ টাকা। ঢাকা শহরের স্থানীয় বাজারে দাম আরও বেশি হওয়ার কথা।
গতবারের চেয়ে এবারে সবজিতে প্রচুর লোকসান কৃষকের, জানালেন লিয়াকত আলী। শুধু এই এলাকা কেন, সারা দেশেরই চিত্র এই। মহাজনেরা, আড়তদারেরা অতি সস্তায় কিনে বিক্রি করে ৪/৫ গুণ বেশি দামে। আর ওই যে বিল, সেটা ইজারা নিয়েছে এলাকার প্রভাবশালীরা। আগের মতো সেখানে মাছও ধরা যায় না। ওদিকে এগিয়ে আসছে শহুরে ক্রেতারা। কৃষিজমিতে তৈরি হচ্ছে কারখানা কিংবা আবাসন ব্যবসার প্লট। লিয়াকতের পাশের জমিটাও বিক্রি হয়ে গেছে। বিলের পাশে দেয়ালঘেরা জায়গাটা কৃষির সঙ্গে বিরোধের পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘দূরে কাছে কেবলই গ্রাম পতনের শব্দ শুনি’। ঢাকার পাশে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া, হযরতপুর, রুহিতপুরে হাজার হাজার একর কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে আছে। যারা সেগুলো কিনেছে বা দখলে পেয়েছে, তারা কৃষি চায় না, ব্যবসা চায়। লিয়াকত কিংবা জয়নালের মতো চাষিরা বাজার, নগরায়ণ ও ফসলের রোগবালাইয়ের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। তাঁরা তখন জমির ফলন বাড়িয়ে লোকসান কমানোয় মন দেন। আর বেশি বেশি বিষাক্ত সার ও কীটনাশক ঢালেন। আর এভাবেই বাংলার দুঃখী কৃষকের দেহ ক্যানসারের বাসা হয়ে ওঠে।
লুকিয়ে আছে ভয়ংকর বিপদ
বণিক বার্তার অনলাইনে ১৫ জানুয়ারির একটি খবর বলছে, দেশের একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি ক্যানসার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে প্রতিবছর যত রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কৃষক।বিজ্ঞাপন
এই যে সুন্দর গ্রাম, সরল কৃষক পরিবার, তার পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর এই বিপদ। হাসপাতালটির ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক্যানসার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট: ২০১৫-১৭’ প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, ক্যানসার শনাক্তকৃতদের মধ্যে কৃষকের হারও এখন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে হাসপাতালটিতে ক্যানসারে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন ১০ হাজার ৩১০ জন। তাঁদের মধ্যে ৩০ দশমিক ২ শতাংশই কৃষক। ২০১৬ সালে শনাক্তকৃত ১১ হাজার ১৫ জনের মধ্যে কৃষক ছিলেন ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ৪৪ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন, তাঁদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ ছিলেন কৃষক।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফসলের রোগবালাই ও কীটপতঙ্গ দমনের জন্য কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, পতঙ্গনাশক ও রোডেন্টিসাইড (ইঁদুর মারা বিষ) ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবছর এসব কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে গড়ে ৩৫-৩৭ হাজার টন। এ ছাড়া বছরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার হচ্ছে ৫০ লাখ টনের বেশি। কৃষকের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি এসব উপকরণের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সার্বিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশেও দেখা যাচ্ছে বিরূপ প্রভাব।
মাটির মায়ায় মাটি কামড়ে থাকা কৃষক কেন মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন, ফি বছরের লোকসানি আর গণহারে ক্যানসারের ছোবল তার একটা ব্যাখ্যা দেয়।