হুমকির মুখে সেন্ট মার্টিন’স, কী করবে সরকার?
বাংলাদেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন’স অযত্ন, অবহেলা আর অজ্ঞতার কারণে এটি হুমকির মুখে পড়েছে। জনযট, দুর্যোগ-দূষণে দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে এর বিভিন্ন প্রজাতি। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন হওয়ার মুখে। এমতাবস্থায় কোরাল সৌন্দর্য সংরক্ষণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে সরকারের।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশিয়ান গভর্নেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮০ সালে এ দ্বীপে ১৪১ প্রজাতির কোরাল ছিল। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১২৭টিতে। আর ১৯৯৭ সালে কমে হয় ৬৫টি।
এ হারের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়, ২০৩০ সালে কোরাল প্রজাতির সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ২৪টিতে। আর ২০৪৫ সাল নাগাদ সব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, একসময় এ দ্বীপে ছিল ১৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫৭-১৯১ প্রজাতির শামুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ৪ উভচর প্রজাতি এবং ২৯ সরীসৃপ প্রজাতি। কালের পরিক্রমায় এর মধ্যে অনেক প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে।
দিন দিন সেখানকার বাস্তুসংস্থান এবং জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়েছে। এজন্য অনেকাংশে দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একে অবজ্ঞা। তবে মূল দায় অপরিকল্পিত পর্যটনের। ’৮০ এর দশকের শুরুতে প্রথম প্রকাশ্যে আসে এ কোরাল দ্বীপ। ওই সময় সিনেমা ও গণমাধ্যমে ঢালাওভাবে এর ছবি প্রচার হয়।
এরপর ব্যাপক হারে সেখানে পর্যটন বাড়ে। ফলে এ দ্বীপের যত্রতত্র অসংখ্য বহুতল হোটেল গড়ে উঠেছে। বর্তমানে যা ১৫০টিরও বেশি। একসময় হোটেলগুলো ছিল এক থেকে দুই তলা বিশিষ্ট। এখন সেগুলোর অধিকাংশই বহুতলবিশিষ্ট। উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মানববসতিও। এখানে এখন ১০,০০০ লোকের বসবাস।
মনোমুগ্ধকর দ্বীপটিতে দ্রুতগতিতে পর্যটক বাড়ায় হু হু করে বেড়েছে আবাসিক হোটেলের সংখ্যা। বর্ধিত দর্শনার্থীদের খাবার সরবরাহ ছাড়া বিভিন্নভাবে আতিথেয়তা দিয়ে থাকে সেগুলো। কিন্তু এতে পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই।
প্রতিরাতে এখানে গড়ে ৪,০০০ এর বেশি পর্যটক অবস্থান করেন। এক্ষেত্রে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা বলা যায়। এখানে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে মূলত তারাই ছাড়পত্র দিয়ে থাকে। অথচ ১৯৯৯ সালে একে পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা।
সাগর জলে ভেসে ওঠা নয়নাভিরাম এ দ্বীপে ওই সময় এক ডজনের (১২টি) মতো হোটেল ছিল। সেন্ট মার্টিন’স ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বলেন, সংশ্লিষ্ট আইন ভঙ্গ করে এখানে ১৮টি ছোট স্থাপনা এবং অন্যান্য হোটেল তৈরি করা হয়েছে।
এর মানে বৈচিত্র্যে ঠাসা চিরসবুজ এ দ্বীপ সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনায় প্রায়োগিক তথা যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। অধিকন্তু সেখানে ভ্রমণে প্রতিদিন পর্যটকের সংখ্যা ১,২৫০ জনের নিচে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা।
পরিবেশ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কোরাল রক্ষায় অনিন্দ্যসুন্দর দ্বীপ ভ্রমণে পর্যটকদের ওপর ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। প্রাণিবৈচিত্র্য রক্ষায় অন্যান্য পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ আইনের আওতায় কোস্টগার্ডকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা বলছে, আমাদের কেবল উচ্চ শব্দ ও অতিরিক্ত আলো নিয়ন্ত্রণে এবং একনাগাড়ে সংলগ্ন ছেঁড়াদ্বীপে দর্শনার্থীদের ভ্রমণ সীমিত রাখতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রাকৃতিক নৈসর্গের দ্বীপটি এখন জনশূন্য এবং জোয়ার-ভাটা থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখানে কোনো যানবাহন আর যায় না। তবে পর্যটক প্রবেশে কিংবা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়নি।
প্রায় ১৬ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ এ দ্বীপের আকর্ষণ সৈকতজুড়ে প্রবাল পাথরের মেলা, সারিসারি নারিকেল গাছ, সমুদ্রের নীল জলরাশি এবং এখানকার অধিবাসীদের বিচিত্র জীবনযাপন।
অর্থাৎ এটি একক কোনো কোরাল দ্বীপ নয়, জীববৈচিত্র্যে ভরা। যা ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্পদ। স্বভাবতই এর সঙ্গে অনৈতিক আচরণ করা ঠিক হবে না। একে সংরক্ষণে সরকারকে অবশ্যই কাজ করতে হবে।
এজন্য যা যা করতে হবে:
-সেন্ট মার্টিন’স দ্বীপে পর্যটন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে হবে।
-পরিকল্পিত বিধিনিষেধ আরোপ করে দ্বীপের প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
-সেখানে প্রতিদিন ভ্রমণে পর্যটকদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে হবে।
-এখানকার বাস্তুসংস্থান ও প্রাণিবৈচিত্র্য সুরক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে।
– চটজলদি ক্ষতিপূরণে কাজ করতে হবে।
-যে করেই হোক দূষণ বন্ধ করতে হবে।
-অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ রুখতে হবে।
-গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ রক্ষায় প্রকল্প হাতে নিতে হবে।