গাছ, দান বাক্স কিছুই ছাড়েননি সাকাওয়াৎ

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিচালক ড. প্রকৌশলী মো. সাকাওয়াৎ আলী প্রায় সাড়ে আট বছর রাজধানীর দারুসসালাম এলাকায় বাংলাদেশ কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিকেটিটিসি) অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পদোন্নতি পেয়ে গত মে মাস থেকে তিনি কাজ করছেন বিএমইটির পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিচালনা) হিসেবে। বিকেটিটিসির অধ্যক্ষ থাকার সময় সরকারি গাছ বিক্রি, পৃথক একটি প্রকল্পে বিকেটিটিসির বিদ্যুৎ সরবরাহ, কোয়ার্টার বরাদ্দসহ নানা অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
দারুসসালাম এলাকাতেই তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা সাকাওয়াৎ আলীর। আরও একটি ফ্ল্যাট কেনার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন তিনি। নিজের একাধিক বাসা থাকার পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারি কোয়ার্টারে রয়েছেন সাকাওয়াৎ দম্পতি। বিকেটিটিসিতে থাকার সময় তিনি ভবনের বিভিন্ন স্থানে ও শ্রেণি কক্ষে মসজিদের নামে দান বাক্স রাখতেন। শিক্ষার্থী ও সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে শ্রমিক ভিসায় বিদেশগামীদের দান বাক্সে টাকা ফেলতে বাধ্য করানো হতো। তাতে মাসে কত টাকা উঠত বা তা কোথায় যেত, তা সাকাওয়াৎ আলী ছাড়া কেউই জানেন না।
৮০টি গাছ উধাও :কল্যাণপুর-গাবতলী সড়কের টেকনিক্যাল মোড়ের কাছেই বাংলাদেশ কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি)। প্রধান সড়কের সঙ্গেই এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান গেট। গেট দিয়ে ঢুকলেই হাতের বাম পাশে মূল ভবনের সামনে ফুলের বাগান। তবে একসময় সেখানে ছিল বড় বড় বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ। কিন্তু সৌন্দর্য বর্ধনের নামে বন উন্নয়ন কমিটি বা সরকারি কোনো দপ্তরের অনুমতি ছাড়াই সেখানকার প্রায় ৬৫টি তরতাজা গাছ কেটে ফেলেন বিকেটিটিসির সে সময়ের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ড. সাকাওয়াৎ আলী। কেটে ফেলা হয় চত্বরের আরও অন্তত ১৫টি গাছ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, আনুমানিক দুই-আড়াই বছর আগে সাবেক অধ্যক্ষ প্রায় ৮০টি গাছ কেটে ফেলেন। যেগুলোর বয়স ছিল ২০ বছরের ওপর। গাছ বিক্রির টাকা সরকারি তহবিলে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন তিনি। পাশাপাশি অপূরণীয় ক্ষতি হয় পরিবেশের।
এ প্রসঙ্গে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ.এস.এম. জহির উদ্দিন আকন বলেন, ঢাকাসহ প্রতিটি জেলায় বন উন্নয়ন কমিটি রয়েছে। সরকারি যে কোনো স্থাপনায় গাছ কাটতে হলে এই কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। গত ২২ ডিসেম্বর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যেসব গাছ কাটা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগের গোড়া মাটির ওপরের অংশে বেরিয়ে রয়েছে। সেগুলো দেখলেই বোঝা যায়, গাছগুলো ছিল বেশ মোটা। গাছ কাটার কথা স্বীকার করে সাকাওয়াৎ আলী সমকালকে বলেন, বড় কোনো গাছ ছিল না, অল্প কয়েকটি ডালপালা ছিল। তাই কেটে ফেলা হয়েছিল। গাছ বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছিল কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব গাছ তো একবারে কখনও কাটা হয়নি। যখন ঝড়ে পড়ে গিয়েছিল, তখন কাটা হয়েছে।
প্রজেক্টে বিদ্যুৎ যায় বিকেটিটিসি থেকে :অধ্যক্ষ সাকাওয়াৎ আলী বিকেটিটিসি-সংলগ্ন ঢাকা টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। তবে কয়েকদিন আগে তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের জন্য আলাদা কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ না নিয়ে বিকেটিটিসির বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তিনি। একই সঙ্গে বিকেটিটিসির অধ্যক্ষ এবং প্রকল্প পরিচালক হওয়ায় তিনি প্রভাব খাটিয়ে বিকেটিটিসির বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন প্রকল্পটিতে।
এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হওয়ার আগে ২০১৮ সালের জুন মাসে বিকেটিটিসির বিদ্যুৎ বিল এসেছিল দুই লাখ ৯১ হাজার টাকা। প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ২০১৯ সালের জুন মাসে আসে বিল পাঁচ লাখ সাত হাজার টাকা। অর্থাৎ দুই লাখ ১৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করতে হয় বিকেটিটিসিকে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে দুই লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং প্রকল্প শুরু হওয়ার পর ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিল হয় তিন লাখ ৬৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে অতিরিক্ত বিল দিতে হয় এক লাখ দুই হাজার টাকা। এভাবে প্রতিমাসেই লাখ টাকার বেশি বিল দিতে হয় বিকেটিটিসিকে।
বিকেটিটিসি থেকে প্রকল্পে বিদ্যুৎ নেওয়ার কথা স্বীকার করে সাকাওয়াৎ আলী বলেন, বিকেটিটিসি থেকে নেওয়া বিদ্যুতের টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। বিল প্রতিমাসে ট্রেজারি চালানে জমা দেওয়া হয়। চালানের কপি বর্তমান অধ্যক্ষ প্রকৌশলী লুৎফর রহমানের কাছে আছে।
তবে বিকেটিটিসির অধ্যক্ষ প্রকৌশলী লুৎফর রহমান সমকালকে বলেন, প্রজেক্টের বিদ্যুৎ বিল প্রজেক্ট থেকে দেওয়া হয় না। চালান কপি থাকবে কীভাবে? বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য প্রকল্প পরিচালককে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রজেক্ট থেকে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়নি। বিএমইটির মহাপরিচালককে এ বিষয়ে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
দান বাক্স বাণিজ্য :তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সালের ৯ নভেম্বর সাকাওয়াৎ আলী অধ্যক্ষ হিসেবে ঢাকার বিকেটিটিসিতে যোগ দেন। একটানা প্রায় সাড়ে আট বছর সেখানে দায়িত্ব পালনের পর গত মে মাসে বিএমইটির পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিচালনা) হিসেবে বদলি হয়ে যান।
বিকেটিটিসির একাধিক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, সাকাওয়াৎ আলী অধ্যক্ষ থাকার সময় প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে মসজিদের নামে দান বাক্স রাখতেন। কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে ঢুকতে দেরি করলে জরিমানা হিসেবে তাকে দানবাক্সে কমপক্ষে ৫০ টাকা ফেলতে বাধ্য করা হতো। অধ্যক্ষ এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, সেখানে কোনো কোনো শিক্ষক প্রতিবাদ করতে চাইলেও চাকরিসংক্রান্ত ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কায় নীরব ছিলেন।
অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে শ্রমিক ভিসায় যারা বিদেশ গিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগকেই কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে বিকেটিটিসির বিভিন্ন স্থানে রাখা দান বাক্সে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক জানান, দান বাক্সে মাসে কত টাকা উঠত সেই তথ্য সাকাওয়াৎ আলী কাউকেই জানাতেন না। তবে তারা যেভাবে বিদেশগামী ও শিক্ষার্থীদের টাকা ফেলতে দেখেছেন, তাতে মোটা অঙ্কের টাকাই প্রতি মাসে জমার কথা। এই টাকার কিছু অংশ মসজিদের উন্নয়নে খরচ করা হতো। বাকি টাকা কোথায় তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে বিকেটিটিসির বর্তমান অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. লুৎফর রহমান সমকালকে বলেন, তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বিকেটিটিসির বিভিন্ন জায়গায় ও শ্রেণিকক্ষে দান বাক্স থাকতে দেখেছেন। তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেগুলো সরিয়ে ফেলেছেন।
দারুসসালামে তিন ফ্ল্যাট :তথ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে দারুসসালাম রোডের ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলার ফ্লোরটি ড. প্রকৌশলী সাকাওয়াৎ আলী দম্পতির। এতে দুটি ইউনিট। ২০১৪ সালে সাকাওয়াৎ দম্পতি ফ্ল্যাট দুটি কিনেছেন। সেখানে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, সাকাওয়াৎ দম্পতি ফ্ল্যাট দুটি ভাড়া দিয়েছেন। প্রতিমাসে সাকাওয়াৎ আলীর স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন ভাড়ার টাকা নিয়ে যান ভাড়াটের কাছ থেকে।
দারুসসালাম বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন দারুসসালাম অ্যাপার্টমেন্ট ফেজ-১-এ সাকাওয়াতের একটি আলিশান ফ্ল্যাট রয়েছে। কয়েক বছর আগে সেটি তিনি নিজের নামে কিনেছেন। সরেজমিনে ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে টানানো ফ্ল্যাট মালিকদের নামের তালিকায় দেখা যায় বোর্ডের পাঁচ নম্বরে ৪/এ ১ ফ্ল্যাটটির মালিক হিসেবে ড. প্রকৌশলী মো. সাকাওয়াৎ আলীর নাম লেখা রয়েছে। এই অ্যাপার্টমেন্টের ১৪ তলায় আরেকটি ফ্ল্যাট কেনার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন তিনি। জানা গেছে, ফ্ল্যাট ছাড়াও তার বিভিন্ন সম্পদ রয়েছে।
ড. প্রকৌশলী সাকাওয়াৎ আলী সমকালকে বলেন, ‘১৪ তলায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েছিলাম। পরে কেনা হয়নি। চার তলার একটি ফ্ল্যাট কিনেছি প্রায় চার বছরে আগে।’ ৫০ দারুসসালামে পাঁচতলার ফ্ল্যাট দুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কে বলেছে ওখানে আমার ফ্ল্যাট আছে? ওগুলো আমার শ্বশুরের।’ তবে এক পর্যায়ে প্রশ্নের মুখে বলেন, ‘একটি আমার নামে, আরেকটি আমার স্ত্রীর। জমি বিক্রি করে ওটা কিনেছি। স্ত্রীরটা শ্বশুর দিয়েছেন।’
স্ত্রীর নামে কোয়ার্টার বরাদ্দ নিতে তুলকালাম :বিকেটিটিসি চত্বরেই রয়েছে সরকারি কোয়ার্টার। সাকাওয়াৎ আলীর স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন বিকেটিটিসির ইন্সট্রাক্টর। সাকাওয়াৎ আলী যখন অধ্যক্ষ ছিলেন তখন তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে কোয়ার্টার বরাদ্দ পেয়েছিলেন এবং সেই বাসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন। এটি তার জানা ছিল যে, পদোন্নতি পেয়ে তিনি বদলি হলে কোয়ার্টারের বাসাটিও ছাড়তে হবে।
এ কারণে সরকারি কোয়ার্টারের সিআই ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটটি তিনি খালি অবস্থায় প্রায় সাড়ে তিন বছর রাখেন এবং গত মে মাসে বদলি হওয়ার সময় অধ্যক্ষের বাসা ছেড়ে দেওয়ার আগে সেটি স্ত্রী ইন্সট্রাক্টর আম্বিয়া খাতুনের নামে বরাদ্দ দেন। এই ফ্ল্যাটটি ২০১৭ সালের প্রথম দিকে চিফ ইন্সট্রাক্টর আব্দুর রহমান অবসরে যাওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছিলেন। ইন্সট্রাক্টর আম্বিয়া খাতুনের নামে বরাদ্দ করা চিফ ইন্সট্রাক্টর পদমর্যাদার এ বাসায় বর্তমানে সাকাওয়াৎ পরিবার বসবাস করছে।
প্রসঙ্গত, প্রায় সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় বাসাটি খালি ফেলে রাখায় ভাড়া হিসেবে সরকারের তহবিলে কোনো টাকা জমা হয়নি। অথচ চিফ ইন্সট্রাক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দ বাসা হিসেবে এটি থেকে মাসিক ভাড়া কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা আসার কথা। সে হিসেবে সাড়ে তিন বছরে ১০ লক্ষাধিক টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। ইন্সট্রাক্টর হিসেবে আম্বিয়ার নামে বাসাটি বরাদ্দ হওয়ার কথা নয়। কারণ ছয় ইউনিটের তিনতলা ভবনটি ভাইস প্রিন্সিপাল ও চিফ ইন্সট্রাক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য। শুধু তাই-ই নয়, ঢাকায় ফ্ল্যাট মালিক হওয়ায় আম্বিয়া খাতুন সরকারি বাসা বরাদ্দ নিয়ে বাংলাদেশ বরাদ্দ বিধিমালা ভঙ্গ করেছেন। বিধিমালায় বলা আছে- কোনো সরকারি কর্মচারীর নিজের নামে কর্মস্থল এলাকায় বাসা থাকলে তিনি সরকারি আবাসন পাওয়ার যোগ্য হবেন না।
এ বিষয়ে সাকাওয়াৎ আলী বলেন, কোয়ার্টারের বাসা খালি রাখা হয়নি। মেরামতের কাজ চলছিল। মেরামত করতে এত বছর লাগে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কতদিন লেগেছে তা মনে নেই। নিজের বাড়ি থাকার পরও কোয়ার্টার বরাদ্দ পান কীভাবে? এ কথার উত্তরে তিনি বলেন, নিজের নামে বাসা থাকলে অবশ্য কোয়ার্টারে থাকা ঠিক নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *