কাদের মির্জার প্রতিপক্ষ বাদল গ্রেফতার

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের বিরোধের ঘটনায় অবশেষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার বিকালে নোয়াখালী প্রেস ক্লাব এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হলো। মঙ্গলবার রাতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে।

এর মধ্যে এক মামলায় বাদলকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া কাদের মির্জা, তার ভাই এবং ছেলেকে আসামি করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলার এজাহার দাখিল করা হয়েছে।

তবে রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিহত আলাউদ্দিনের ভাই এমদাদ হোসেনের দাখিল করা এজাহার মামলা হিসেবে রেকর্ড করেনি পুলিশ।

এজাহারে কাদের মির্জা, তার ভাই শাহাদাত হোসেন ও ছেলে মির্জা মাশরুর কাদের তাশিকের নাম থাকায় পুলিশ তা রেকর্ড করতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাত সাড়ে ১২টায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় গিয়ে অফিসার্স ইনচার্জ মীর জাহেদুল হক রনিকে পাওয়া যায়নি।

তার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেনি। তবে রাত পৌনে ১টায় এক প্রশ্নের জবাবে এজাহার দাখিলকারী এমদাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এজাহার পরিবর্তন করা হবে না। আপনাদের সহযোগিতা আমার দরকার আছে। শুক্রবার (আজ) সকাল ১০টায় আপনাদের সবশেষ খবর জানাব।’

বৃহস্পতিবার বসুরহাট পৌর ভবনের চারদিক ঘিরে রাখেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য। এদিন রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভবনটির ভেতরে পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা তার অনুসারীদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন।

এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জের রাজনৈতিক হাব (কেন্দ্রবিন্দু) রুপালি চত্বরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয়ও মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বসুরহাটে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। একরকম আতঙ্কে আছেন স্থানীয়রা। এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুক লাইভে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন কাদের মির্জা।

গত দেড় মাস ধরে কাদের মির্জার সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের বিরোধ চলছে।

এ নিয়ে উপজেলাজুড়ে এক অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সময়ে দুপক্ষের দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

এতে মঙ্গলবার সিএনজিচালক ও যুবলীগ কর্মী আলাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, আহত হন অর্ধশতাধিক। এর আগে আরেক সংঘর্ষে সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির নিহত হন।

বুধবার রাতে মেয়র আবদুল কাদের মির্জার অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা আরিফুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। সেখানে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খান, সাধারণ সম্পাদক নূরন্নবী চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আজম পাশা চৌধুরী রুমেলসহ ৯৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়েছে ১৫০-২০০ জনকে। এ ছাড়া এ মামলায় আসামি করা হয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক ইকবাল হোসেন মজনু ও প্রশান্ত সুভাষ চন্দ্রকে।

এই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত সোমবার (৮ মার্চ) নারী দিবসে বসুরহাট বাজারে আলেয়া ভবনে মেয়র আবদুল কাদের মির্জার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে কর্মসূচি পালন করার সময় হামলা চালানো হয়।

হামলাকারীরা বসুরহাট বঙ্গবন্ধু চত্বরে এসে মুজিবশতবর্ষ পালনের মঞ্চেও তাণ্ডব চালায়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছবি ভাঙচুর, মালামাল লুটসহ অনেককে মারধর ও আহত করে।

এর আগে বুধবার বিকালে পুলিশের কাজে বাধা, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করে।

যেভাবে গ্রেফতার : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৪টার দিকে নোয়াখালী প্রেস ক্লাব এলাকার রেড ক্রিসেন্ট ভবনের নিচে একটি দোকানে বসা ছিলেন মিজানুর রহমান বাদল।

এ সময় সাদা পোশাকের কয়েক ব্যক্তি সেখানে গিয়ে বাদলের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ডেকে দূরে নিয়ে কথা বলতে চান।

এতে বাদল আপত্তি জানালে তারা বলেন, ‘আপনি ভদ্র মানুষ। আশা করি আপনাকে দ্বিতীয়বার কোনো কথা বলতে হবে না।’ তখন তিনটি সাদা মাইক্রোবাস এসে সেখানে থামলে একটিতে বাদলকে তুলে নিয়ে চলে যায় ওই ব্যক্তিরা।

বাদলের স্টেটাস : বিকাল ৪টার দিকে বাদলকে সাদা পোশাকের লোকজন নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাদলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্টেটাস দেখা যায়।

সেখানে তিনি লেখেন: ‘সবাই ধৈর্য ধরুন। দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতেও প্রিয় নেত্রী ও প্রিয় নেতার অপমান আমরা সইব না। কোম্পানীগঞ্জকে অপশাসনের হাত থেকে মুক্ত করব, ইনশাআল্লাহ। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেখা হবে মুক্ত কোম্পানীগঞ্জে।’

এ স্টেটাস ছড়িয়ে পড়ার পর তার অনুসারীরাও এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করেছেন।

ফেসবুক লাইভে মির্জা : আবদুল কাদের মির্জা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা অপরাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে রাজনীতি করা যায় না।

তাই দরকার হলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে আমি থাকব না। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদে কাজ করব।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করব। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে তিনি এসব কথা বলেন।

কাদের মির্জা আরও বলেন, আমি অপরাজনীতি, টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে কথা বলেছি, বলেও যাব। আমি সাহস করে সত্য কথা বলব।

অন্যায়-অনিয়মের প্রতিবাদ করব। অপরাজনীতি যারা করে তাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের দিয়ে কমিটি করতে হবে। আর কোম্পানীগঞ্জের শান্তি ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্র থেকে নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে সব ঘটনার তদন্ত করতে হবে।

গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, এনএসআই আছে তারাও তদন্ত করতে পারে। আমি এবং আমার কর্মীরা যদি কোনো অপকর্মে জড়িত থাকি তাহলে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন।

কাদের মির্জা আরও বলেন, যারা ভোট ডাকাতি করে নির্বাচিত হতে চান, তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমি ও আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার নেতাকর্মীদের হত্যার নানা ষড়যন্ত্র করছে।

গণবাহিনীর সদস্য ও ব্যাংক ডাকাতরা লোভের বসে একরামুল করিম চৌধুরী এমপি ও নিজাম হাজারী এমপির সঙ্গে এক হয়ে কাজ করছে।

কিছু কুলাঙ্গার মিলে ফেনী ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল থেকে অস্ত্র এনে আমাকে ও আমার কর্মীদের হত্যার চেষ্টা করছে। এখানে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা এসব মেনে নেবেন না।

আতঙ্কে সাধারণ মানুষ : প্রাচীন উপজেলা সদর কোম্পানীগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল। প্রতিদিনের মতোই সকালে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসেন ব্যবসায়ীরা। বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী। এরপরই বড় বাণিজ্য কেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট।

এখানে গভীর রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকলেও এখন সন্ধ্যা নামার পরপরই বেশিরভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এ পরিবর্তন কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার পর থেকেই।

এক মাসের ব্যবধানে ব্যস্ততম বসুরহাটের এ পরিবর্তনই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলে।

পৌর ভবন ঘিরে পুলিশ-র‌্যাব : সরেজমিন দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বসুরহাট পৌর ভবনের চারদিক ঘিরে রেখেছেন পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা। সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সদস্যরাও রেখেছেন কড়া নজরদারি।

এ নজরদারির ভেতরই পৌর ভবনের একটি কক্ষে নিজের অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ে আবদুল কাদের মির্জা অবস্থান করছেন। সন্ধ্যার দিকে কাদের মির্জার স্ত্রী আক্তার জাহান বকুল স্বামীর ব্যাবহারিক কিছু জামা-কাপড়সহ একটি ব্যাগ নিয়ে সেখানে যান।

সন্ধ্যার পর একজন আইনজীবীও কাদের মির্জার সঙ্গে দেখা করে পৌর ভবন থেকে বের হন। এ নিয়ে কাদের মির্জার অনুসারী নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক জেঁকে বসেছে।

এ অবস্থায় মির্জা কাদেরের ছোট ভাই শাহাদাত হোসেনকে র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়।

এ ছাড়া জিরো পয়েন্টে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু চত্বর, রুপালি চত্বর, উপজেলা হাসপাতাল গেট, কলেজ গেট ও উত্তর বাজার এলাকায় পুলিশ ও র‌্যাবের সতর্কাবস্থান দেখা গেছে।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের বৈঠক : একদিকে বিকালে মাইজদী শহর থেকে বাদলকে তুলে নেয় সাদা পোশাকের পুলিশ আর অন্যদিকে মাইজদীর নিজস্ব কার্যালয় ছেড়ে ২৭ কিলোমিটার দূরে কোম্পানীগঞ্জ থানায় আসেন জেলার পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন।

বিকাল ৫টার দিকে থানায় ঢুকেই তিনি ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলা বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

মির্জা প্রধান আসামি : বৃহস্পতিবার রাতে নিহত আলাউদ্দিন হত্যা মামলায় তার ভাই এমদাদ হোসেন বাদী হয়ে থানায় দাখিল করা এজাহারে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জাকে প্রধান আসামি করা হয়।

এ ছাড়াও কাদের মির্জার ছোট ভাই শাহাদাত হোসেন, ছেলে মির্জা মাশরুর কাদের তাসিকসহ ১৬৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০-৪০ জন এ মামলার আসামি।

এতে বলা হয়, আসামি কাদের মির্জার নেতৃত্বে সব আসামি পূর্বপরিকল্পিতভাবে পিস্তল, শটগান, পাইপগান, রামদা, রড, ককটেলসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ৫০-৬০টি ককটেল ফুটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং প্রতিবাদসভায় হামলা চালায়।

চার নম্বর আসামি নাজিমউদ্দিন বাদল আলাউদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেন।

বাদলের উত্থান যেভাবে : ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করে বেড়ে ওঠেন মিজানুর রহমান বাদল। চরফকিরা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে শুরু করে এখন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি।

এ সময়ের মধ্যে নোয়াখালীর আলোচিত সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নির্বাচিত হন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান। ২০১৯ সালেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান বাদল।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন্নেসা কাদের ও ইকরামুল করিম চৌধুরী তাকে সমর্থনও দেন। কিন্তু আবদুল কাদের মির্জার বিরোধিতায় মনোনয়নবঞ্চিত হন বাদল।

এরপর থেকে কাদের মির্জার শত্রুতে পরিণত হন তিনি। এই সুযোগে তাকে কৌশলে কাদের মির্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে আসছিলেন একরামুল করিম চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *