বেসিক ব্যাংকে ৪৫০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি

বেসিক ব্যাংকের অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ৫৬ মামলার তদন্ত কেন শেষ হচ্ছে না বা দোষীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে না-এর কোনো জবাব নেই সংশ্লিষ্টদের।

তাদের মতে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সামনে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নাম থাকলেও পেছনে রয়েছে পরিচালনা পর্ষদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা। রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। তবে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলা দুদকের তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিচালকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এত বড় জালিয়াতি ঘটত না। এর জবাবে পর্ষদের একাধিক সদস্য প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বাচ্চুর একক সিদ্ধান্তে সব ঋণ দেওয়া হয়। পর্ষদে প্রায় সভায় অন্তত তিন হাজার আলোচ্যসূচি থাকত, কিন্তু আলোচনা হতো না। ওই সময় নানা কারণে তারা তেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি।

এদিকে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নেওয়া কী পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, এর সঠিক তথ্য এখনো পায়নি দুদক। ফলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কোনো উদ্যোগও নিতে পারেনি সংস্থাটি। যদিও বেসিক ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে ১৭৫ কোটি টাকা পাচারের তথ্য রয়েছে।

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি মামলার তদন্ত কি অনন্তকাল চলবে-এমন প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্টও। মঙ্গলবার ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখার সাবেক ম্যানেজার মুহাম্মদ আলীর জামিন শুনানির সময় আদালত এ প্রশ্ন তুলেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে মামলার শুনানি হচ্ছিল।

আদালত বলেছেন, পাঁচ বছরেও মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি দুদক। সেই সঙ্গে ব্যাংকের মামলায় ‘ফলো দ্য মানি’ খোঁজার বিষয়টি বাস্তবতাবর্জিত বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। এর আগে শুনানিকালে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আদালতে বলেন, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনায় ৫৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের ৪৫০০ কোটি টাকার বিষয়টি রয়েছে। তিনি জানান, ওই টাকার মধ্যে ৩১০০ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

১৩ মার্চ শেষ হচ্ছে দুদক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদের মেয়াদ। তিনি দুদককে কাঠামোগতভাবে একটি সক্ষমতার জায়গায় নিয়ে এসেছেন। দুদককে মানুষ ভয় পায়-এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। নতুন করে বিধিমালাসহ অনেক কিছু তৈরি করেছেন। কিন্তু তার মেয়াদকালে পাঁচ বছরে বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিয়ে যেতে পারেননি। সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি একাধিকবার বলেছিলেন, বেসিক ব্যাংকের টাকা কোথায় কোথায় গেছে, কীভাবে লেয়ারিং হয়েছে, এর লিংক বের করতে তদন্তে সময় যাচ্ছে।

একজন আইনজীবী বলেন, ‘ফলো দ্য মানি’ বা দুদকের পক্ষ থেকে টাকা খোঁজার কাজটির বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। এর আগেও বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিতে বাচ্চুকে আসামি না করায় উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। এমনকি ব্যক্তি যেই হোক না কেন-এ ধরনের মামলায় আসামি করার ক্ষেত্রে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ যেন না হয়, সে বিষয়ে দুদককে এর আগেও সতর্ক করেছেন আদালত।

জানতে চাইলে ড. ইকবাল মাহমুদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েই সবার চলতে হয়। আমি আশা করব, আগামী কমিশন এসে দেখবে। তদন্তও শেষ করবে। আমরা তদন্তকাজ অনেক দূর এগিয়ে রেখেছি। আমরা পর্ষদ সদস্যদের প্রসিকিউট (জিজ্ঞাসাবাদ) করেছি। আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তদন্ত একদিন শেষ হবেই।

জানা যায়, তদন্তকালে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় দুদক। এর একপর্যায়ে তদন্ত ফাইলবন্দি হয়ে যায়। তদন্তকাজ স্থবির হয়ে যাওয়া নিয়ে যুগান্তরের তরফ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু বাচ্চু একা নন। এর নেপথ্যে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন।

বাচ্চুর নেতৃত্বে ২০০৯-২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই মেয়াদের মোট ১৪ জন পর্ষদ সদস্যের মধ্যে ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও অর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ, তৎকালীন বাণিজ্য সচিব শুভাশীষ বোস, ফখরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিম, একেএম কামরুল ইসলাম এফসিএ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম এফসিএমএ, আনিস আহমেদ, একেএম রেজাউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নিলুফার আহমেদের সঙ্গে কথা বলে দুদক টিম।

বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক বাণিজ্য সচিব ও ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালক শুভাশীষ বোস শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বাচ্চুর জন্য এমনটি হয়েছে। এজেন্ডার বাইরে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘আপনারাও কম দায়ী নন। আপনাদের গাফিলতির কারণে এমনটি হয়েছে’-এমন প্রশ্নে শুভাশীষ বোস বলেন, আমরা কেন দায়ী হব। আপনি মি. ‘এ’-কে ঋণ না দিয়ে মি. ‘বি’-কে ঋণ দিয়েছেন। তা তো আমরা জানতাম না।

এসব ঋণে আমার সই আছে? কোনো রেজুলেশন দেখাতে পারবেন? আপনারা তাহলে চুপ ছিলেন কেন-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সরকারের পরিচালক। সরকারের অবস্থা চিন্তা করে চুপ থাকতে হয়েছে। আমরা তো তার (বাচ্চু) সঙ্গে মারামারি করব না। আমি মনে করি, বেসিক ব্যাংকের তদন্তের সুরাহা হওয়া উচিত। কারা ‘রেসপনসিবল’, দুদককে দেখা উচিত। ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে রেজুলেশন করার পর তা বাংলাদেশ ব্যাংকেও পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) কী করেছে?

পর্ষদের অপর একজন সদস্য (পরিচালক) যুগান্তরকে বলেন, আমি অনেক কিছুই বলতে পারি। নামটা উল্লেখ না করলে এইটুকু বলব, আমি পর্ষদের সভায় যাওয়ার আগেই দেখতাম সভা শুরু হয়ে যেত। পর্ষদকে অন্ধকারে রেখে সব ঋণ দিয়ে দিতেন তিনি (বাচ্চু)। জানি না তিনি এত ক্ষমতা কোথায় পেলেন। তিনি নিজের ক্ষমতাবলেই সব করতেন।

সভার আগের রাতে তিন হাজার আলোচ্যসূচি পাঠাত আমাদের কাছে। তারা জানত হাজার হাজার আলোচ্যসূচি আমাদের দেখা সম্ভব নয়। তাই হয়তো এমনটি করেছে। আমি মনে করি, ১০-২০টি ঋণের আলোচ্যসূচি সভায় উপস্থাপন করা হলে পর্ষদ ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারত।

আবদুল হাই বাচ্চুকে সর্বশেষ দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর। এর আগে তাকে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এছাড়া একই সময়ে পর্ষদ সদস্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি (বাচ্চু) ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে পর্ষদের ওপর দায় চাপনোর চেষ্টা করেন। বাচ্চু বলেছেন, পর্ষদ সদস্যরা সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখেননি। তবে ত্রুটিপূর্ণ ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের সময় বোর্ড সভার হাজিরা খাতায় ও সভার রেজুলেশনে বাচ্চুর স্বাক্ষর দেখিয়ে সেটি তার স্বাক্ষর কি না-জানতে চাইলে সেটা তার স্বাক্ষর বলে তিনি (বাচ্চু) স্বীকার করেছেন।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানসহ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধেও।

প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে এই অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর তিনটি থানায় ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে ২৬ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বাকিরা ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জরিপ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত। তবে আসামির তালিকায় বাচ্চু বা ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের কেউ না থাকায় দুদকের ওই মামলা নিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে। সেই প্রশ্নের মীমাংসা কবে হবে-সেটা এখনো অজানা।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ করা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।

বেসিক ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি অনুসন্ধান ও তদন্তসংশ্লিষ্ট দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন, সব ঋণ অনুমোদন নিয়মনীতির মধ্যে থেকেই করেছেন।

ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যাচাই-বাছাই শেষেই এসব ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, তার দায় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের। অভিযুক্তরা নিজেদের বাঁচাতে তাকে ‘সেফ গার্ড’ হিসাবে ব্যবহার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *