যোগ্য না হয়েও ভাতা নেন ৪৬%

৬০ শতক জমির অর্ধেকে আধা পাকা বাড়ি। বাকি অংশে নিজের নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। চাষের জমি আছে দেড় একর। তিনটি পুকুর লিজ নিয়ে চলছে মাছ চাষ। স্থানীয় বাজারটিও ইজারা নিয়েছেন। তাঁর আয়ের এসব উৎসের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে সরকারের ‘বয়স্ক ভাতা’।

তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভার দেবগ্রামের বাসিন্দা হাজি আবদুর রহিম। বয়স হলেও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তিনি এ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নন।

সরকারি সমীক্ষা বলছে, বয়স্ক ভাতার তালিকায় অনিয়মের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পুরো আয়োজনে অনিয়মের পরিমাণ ৪৬ শতাংশ।

অনিয়ম দূর করে সঠিক লোকের কাছে এসব কর্মসূচির সহায়তা পৌঁছে দিতে পারলে কোনো বাড়তি ব্যয় ছাড়াই আরও ২৬ লাখ পরিবারের ১ কোটি ৭ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে একঝটকায় তুলে আনা সম্ভব।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত ভাতাভোগীদের ৪৬ শতাংশের বেশি ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়। তবে প্রতিবেদনে একে অনিয়ম না বলে বলা হয়েছে, ‘তালিকাভুক্তির ভুল’। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন এই সব তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে (এসএসপি) আরও কার্যকর করতে ২০১৫ সালে সরকার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগের (জিইডি) অধীনে এনএসএসএস গঠন করে। গত বছরের জুলাই মাসে এই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

বেশি অনিয়ম বয়স্ক ভাতায়

বয়স্ক ভাতা নেওয়া প্রসঙ্গে আখাউড়ার হাজি আবদুর রহিম (৬৮) প্রথম আলোকে বলেছেন, বয়স্ক হলেই ভাতা নেওয়া যায় বলে তিনি জানেন। মাসে ৫০০ টাকা করে গত বছর প্রথমবার তিনি ভাতা তুলেছেন।

হাজি আবদুর রহিমের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয় ১৪ জানুয়ারি আখাউড়া পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভায়। উপজেলা কৃষক লীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হিসেবে তিনি ওই সভায় যোগ দেন।

এনএসএসএস প্রতিবেদন বলছে, সামাজিক নিরাপত্তার সব কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘ভুল’ বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিতে। বয়স্ক ভাতা পেতে হলে পুরুষের বয়স কমপক্ষে ৬৫ এবং নারীর ৬২ বছর হতে হয়। এই বয়সের ক্ষেত্রেই ঘটেছে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ ‘ভুলের’ ঘটনা। আর ১৪ শতাংশ ‘ভুল’ হচ্ছে আয়ের ক্ষেত্রে। বয়স্ক ভাতা পেতে হলে মাসে আয় ১০ হাজার টাকার কম হতে হবে। কিন্তু বেশি আয়ের লোকেরাও এই ভাতা নিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী ২০১৯ সালে ভাতাভোগীদের ওপর ছোট্ট পরিসরে একটি জরিপ পরিচালনা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রতিনিধি ও দলীয় লোকজনের পরিবর্তে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে ভাতাভোগীর তালিকা করা হলে অনিয়ম কমানো যেত। ভাতার টাকায় ওষুধসহ প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে পারেন বলে পরিবারে প্রকৃত ভাতাভোগীদের ক্ষমতায়ন হয় বলে মনে করেন তিনি।

‘চোখের সামনে যাদের পাইছি, দিছি’

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের চাকদহ গ্রামের সচ্ছল অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আবু জাফর (৬৮), মোবারক হোসেন (৭০) বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। আবু জাফরের ছেলে সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। স্থানীয় ইউপি সদস্যের বড় ভাই মোবারক হোসেনের দুই ছেলে বিদেশে, এক ছেলে চাকরিজীবী। স্থানীয়ভাবে তাঁদের জমিজমাও আছে। ছেলেদের বিরুদ্ধে বাবাকে দেখভাল না করারও কোনো অভিযোগ নেই।

একই গ্রামের চোখে ছানি পড়া কমল চন্দ্র সরকার (৭০) পাচ্ছেন প্রতিবন্ধী ভাতা। কমল চন্দ্রের এক ছেলে ইতালিপ্রবাসী। কমল চন্দ্র সরকারের ছেলে গৌরাঙ্গ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বাবার চোখে ছানি, কানে শোনেন না, বয়স্কও। এ কারণে হয়তো প্রতিবন্ধী বা বয়স্ক কোনো একটি ভাতা পান। স্থানীয় ইউপি সদস্য তাঁর বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে যান। গত বছর থেকে তাঁর বাবা ভাতা পাচ্ছেন।

একই গ্রামের মৃত লেবু মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৬৫), মৃত ওয়াজ উদ্দিনের স্ত্রী সখিনা আক্তার (৬৩), নকুল শীলের স্ত্রী পারুল শীল (৬৫) দরিদ্র হয়েও বয়স্ক ভাতা কিংবা বিধবা ভাতা পাচ্ছেন না।

মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এক বছর আগে মেম্বারের কাছে আইডি কার্ড ও ছবি জমা দিছিলাম। কাগজপত্র নেওয়ার সময় বলছেন, তোমরা শিগগিরই ভাতা পাবা।’

এ ব্যাপারে হাতীবান্ধা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাসেম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান স্বজনপ্রীতি করেন, আমার এলাকায় ভাতা বরাদ্দ দেন না। তাই আমিও উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের ধরে ৪০টি ভাতার বই নিয়ে আসছি। তারপর চোখের সামনে যাঁদের পাইছি, তাঁদের দিছি। আমার কাছে না আসলে তো আমি খুঁজে খুঁজে ভাতা দিতে পারব না।’

হাসেম মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যাঁরা আপনাকে এসব তথ্য দিছে, তাঁরা কি এই তথ্য দেয় নাই যে চেয়ারম্যান মরা মানুষকে জ্যান্তা দেখাইয়া বই (ভাতা) আনছে! এক মহিলা মেম্বার স্বামী আছে এমন এক নারীকে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা এনে দিছে! আমি কোনো দুই নম্বারির মধ্যে নাই।’

এনএসএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কারণে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ দারিদ্র্য কমছে। কিন্তু উচ্চ ‘ভুলের’ (অনিয়ম) কারণে দরিদ্র নয় এমন লোকের কাছে সরকারি সহায়তার টাকা চলে যাচ্ছে। ফলে কর্মসূচিগুলো খুব কমই প্রভাব ফেলতে পারছে। যথাযথ ব্যক্তির কাছে এই সহায়তা গেলে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ থেকে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে করছে এনএসএসএস। প্রকল্পের অনিয়ম বা ‘ভুল’ দূর করলে কোনো বাড়তি ব্যয় ছাড়াই ২৬ লাখ পরিবারের ১ কোটি ৭ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে আনা যাবে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা গেছে, ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের ১৪৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দেশের প্রায় এক–চতুর্থাংশ পরিবার এ কর্মসূচির আওতায় আছে।

সবাই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করলে ভাতার তালিকা সম্পূর্ণ নির্ভুল হতে ২০-২৫ বছর সময় লেগে যাবে।

এম এ মান্নান, পরিকল্পনামন্ত্রী

এনএসএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্তদের মধ্যে ৫ শতাংশ নারী বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা না হয়েও ভাতা পাচ্ছেন। এই ভাতা পেতে হলে মাসিক আয় ১২ হাজার টাকার কম হতে হয়। কিন্তু তালিকায় মাসিক ১২ হাজার টাকার বেশি আয় করা লোকের সংখ্যা প্রায় ১২ শতাংশ।

পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এ এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরুর সময়ে সরকারের সক্ষমতা ততটা ছিল না। তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে শুধু জনপ্রতিনিধিদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক যে সেখানে অনিয়ম হয়েছে। এখন বারবার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এসব সংশোধন করা হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, সবাই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করলে ভাতার তালিকা সম্পূর্ণ নির্ভুল হতে ২০-২৫ বছর সময় লেগে যাবে।বিজ্ঞাপন

ভাতার তালিকা সংশোধনেও অনিয়ম

যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২ হাজার ২২৮ জন উপকারভোগী আছেন। এর আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি পর্যন্ত চাল কিনতে পারে একেকটি দরিদ্র পরিবার। গত বছরের শেষের দিকে এই তালিকা থেকে ২৬০ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুস্থ নারীদের উন্নয়ন কর্মসূচি ভিজিডিতেও নাম থাকা, মারা যাওয়া, বিদেশে চলে যাওয়া, একই পরিবারে দুটি কার্ড, এলাকা ত্যাগ ইত্যাদি কারণে ৩৬ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাকি ২২৪ জনের নাম বাদ দেওয়া হয় ‘সচ্ছল’ উল্লেখ করে।

কিন্তু তালিকা থেকে বাদ পড়া হারুণ শেখ নামের এক দিনমজুর অভিযোগ করেন, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ওসমান শেখের কাছে তাঁর নাম বাদ পড়ার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। মেম্বার তাঁকে বলেছেন, ‘তিন বছর ধরে চাল পাচ্ছিস। আর কত? সামনে নির্বাচন। আমি নির্বাচন করব। সেই অনুয়ায়ী আমাকে কার্ড দিতে হয়।’

তবে ওসমান শেখ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সবাই সচ্ছল লোক। তাঁদের বাদ দিয়ে অসচ্ছল লোকদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

অনেক অসচ্ছল ব্যক্তির নাম জনপ্রতিনিধিরা বাদ দিয়েছেন—এমন অভিযোগ উঠলে তা নিয়ে উপজেলা থেকে তদন্ত করা হয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে জানিয়ে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সদস্যসচিব ও উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক মীনা খানম প্রথম আলোকে বলেন, সচ্ছল উল্লেখ করে বাদ দেওয়া ২২৪ জনের মধ্যে মাত্র ২০ জনকে সচ্ছল পাওয়া গেছে। শুধু ওই ২০ জনকে তালিকা থেকে বাদ দিতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে ১৯ জানুয়ারি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে জবাব আসার পর নতুন তালিকা অনুসারে বরাদ্দ দেওয়া হবে।

এনএসএসএসের প্রতিবেদন অনুসারে, তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও বাদ পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ঢাকা বিভাগে। অন্তর্ভুক্তির সময় ৮৪ শতাংশ এবং বাদের সময় ৫৮ শতাংশ। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের অবস্থায়ও প্রায় একই। অন্তর্ভুক্তিতে সবচেয়ে কম ‘ভুল’ সিলেট বিভাগের, ৩০ শতাংশের নিচে। বাদ পড়াদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম ‘ভুল’ বরিশাল বিভাগে, ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদের মতে, তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয়। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই এবং তালিকাভুক্তির শর্তগুলোও ত্রুটিপূর্ণ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা রোধে কর্মসূচিগুলোর ব্যাপারে সচেতনতাও বাড়াতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *